সারমর্ম: আফ্রিকার কালো মানুষেরা কিভাবে সাদা মানুষদের ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছিল সেই কাহিনী। মোট- ৪ পৃষ্ঠা
রোডেশিয়া নামক দেশটি এখন জিম্বাবুয়ে এবং জাম্বিয়া
এই দুই নামের দেশে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। পূর্ব নামের রোডেশিয়া দেশটি আফ্রিকা মহাদেশে যুদ্ধ
বিগ্রহের জন্য বিখ্যাত ছিল। যুদ্ধের জন্য বিখ্যাত হলেও রোডেশিয়ার জাতিসত্তা বহন করে
এক প্রাচীন লোক ঐতিহ্য। এর ফলেই যখন কালো মানুষদের আফ্রিকায় বাহিরে থেকে দলে দলে সাদা
মানুষের দল অনুপ্রবেশ করে, তখন যুদ্ধটা সাদা-কালোর যুদ্ধ বলেই সারাবিশ্বে খ্যাতি লাভ
করে। আমাদের আলোচ্য লোককাহিনীটা এ ইতিহাসের ওপরই গড়ে উঠেছে।
অনেক অনেক দিন আগের কথা। তখন পর্যন্ত সাদা মানুষেরা
রোডেশিয়া আসেনি। সেই সময় এক শিকারি এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়। সে বনে শিকার
করছিল। হঠাৎ তার চোখে পড়ে এক সুবিশাল অজগর একটা হরিণকে জড়িয়ে ধরে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে তাকে
হত্যা করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। হরিণও মরিয়া হয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছিল। প্রচন্ড
ধস্তাধস্তির সময় হরিণের একটা ক্ষুরধার শিং অজগরের ঘারের কাছে এক জায়গায় ফুটো করে দিয়ে
পাশের গাছের মধ্যে সেঁধিয়ে আটকে রয়েছে। এখন হরিণ কিংবা অজগর কেউ-ই ঐ অবস্থা থেকে মুক্ত
হতে পারছে না।
হঠাৎ এক শিকারিকে দেখে হরিণ বলল, দয়া করে আমাকে সাহায্য
করুন। আমি কারো কোন ক্ষতি করছিলাম না, তবু আমার এই দশা। আত্মরক্ষা করার চেষ্টা না করলে
ও আমাকে মেরে ফেলতো।
আর অজগর ফোঁস ফোঁস করে বলল, আমি সর্পরাজ ইনসাটো। আমাকে
তুমি মুক্ত করে দাও, তোমাকে আমি মোটা পুরস্কার দেব।
শিকারি পুরস্কারকেই গুরুত্ব দিল। তার হাতের তীক্ষ্ণ
দীর্ঘ বর্শার এক আঘাতে হরিণ মৃত্যুবরণ করল। মরবার আগে হরিণ কোনরকমে টেনে টেনে বলল,
ও ঠিকই আপনাকে পুরস্কৃত করবে কিন্তু ঐ পুরস্কারই আপনার ও আপনার জনগনের জন্য অশেষ দুর্দশা
ডেকে আনবে।
এদিকে অজগর বলল, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ, শিকারি। চাঁদ
ওঠার পরে তুমি এখানে এসো, তোমার পুরস্কারের ব্যবস্থা করবো আমি। ইতোমধ্যে আমি এই হরিণকে
ভক্ষণ করবো, হজম করবো আর তারপর ভোজন শেষে একটু বিশ্রাম করবো।
শিকারি বাড়ি ফিরে যায় এবং চাঁদ ওঠার পর যথাসময়ে ঐ
জায়গায় ফিরে আসে পুরস্কার গ্রহনের আশায়। অজগর তখন তার ভোজন পর্ব ও নিদ্রা শেষে আড়মোড়া
ভেঙ্গে জেগে উঠল। শিকারিকে আরেকবার ধন্যবাদ জানিয়ে সে বলল, আমার সঙ্গে আমার সর্পরাজ্যে
চলো। সেখানে আছে আমার অঢেল ধন সম্পদ। তোমার যেটা খুশি তুমি চাইবে, আমি সঙ্গে সঙ্গে
তোমাকে সেটা দিয়ে দিবো।
তখন শিকারি ও অজগর গভীর অরণ্যের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে
একটা সরু গর্তের কাছে এসে পৌঁছল। মনে হল এই গর্ত নেমে গেছে একেবারে ধরণীর অভ্যন্তরে।
সর্পরাজ বলল, আমি আগে আগে যাচ্ছি তুমি শক্ত করে আমার লেজ ধরে রাখো। আমি তোমাকে টেনে
নিয়ে যাবো।
পৃষ্ঠা ১/ ৪
ঐ পথ ছিল দীর্ঘ এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন, কিন্তু হঠাৎ তারা
একটা উজ্জ্বল আলোকিত জায়গায় এসে পৌঁছাল। এ চমৎকার সুন্দর এক দেশ। সবুজ ঘাসে ঢাকা,
প্রান্তরে গরু, ভেড়া, ছাগল চরছে মনের আনন্দে। দূরে পাথরের বাসগৃহগুলো সারি সারি নৌকার
মতো করে দাঁড়িয়ে আছে, বাড়িগুলোর ছাদ যেন সোনায় মোড়ানো। মসৃণ পাথরের বাড়িগুলো ঝকঝক করছে।
শিকারি মুগ্ধ হয়ে তার সঙ্গির দিকে তাকাতেই দেখে যে,
সেখানে দাঁড়িয়ে আছে সাপের চামড়ায় আচ্ছাদিত দীর্ঘদেহী সুদর্শন এক পুরুষ। তার হাতের আঙুলের
সোনার আঁংটিগুলো চকচক করে জ্বলছে, গলায় ও হাতে খাঁটি সোনার কয়েকটা হার ও বালা।
সঙ্গী শিকারি লোকটিকে বলল- ‘আমিই সর্পরাজ ইনসাটো। কিন্তু নিজের
দেশে আমি মানুষের রূপ ধারণ করে থাকি। এই হল আমার রাজত্ব। এখন চলো আমার সঙ্গে। ঘুরে
দেখ আমার ধনসম্পদ ও রত্নরাজি।’
তারা যেতে যেতে নানা জিনিস দেখল। একটা জলাশয়ে মেয়ে-পুরুষ
স্নান করছে, সাঁতার কাটছে। অন্যত্র একটা বাগানে অনেক হইহুল্লা করতে করতে গাছ থেকে পাকা
ফল পেড়ে খাচ্ছে। অনেকে তাদের জন্য নানা রকমের খাবার, তালের রস ও কচি ডাব নিয়ে এসে আপ্যায়ন
করালো।
গ্রামাঞ্চল পেরিয়ে তারা নগরে প্রবেশ করল। সেখানে রাস্তায়
কাঁকর-বালির পরিবর্তে দেখা গেল সোনার ধুলা। বাড়িঘরে মুক্তার কাজ। রাজপ্রাসাদে ওদের
সেবাযত্নের জন্য দাস-দাসির ভিড়। ইনসাটো শিকারিকে উদ্দেশ্য করে বলল, কাল তুমি তোমার
পুরস্কার বেছে নেবে। তুমি যা চাইবে তাই দেবো।
সেদিন রাতে নিজের ঘরে শিকারি তার গলায় ঝুলানো ছোট
বেতের ঝুড়ি থেকে জেংগি-মিজি বোতলটি বের করে তাকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘ওর কাছে আমি কি চাইবো?’
জেংগি-মিজি, ভোঁ ভোঁ শব্দ করে উত্তর দিল, ‘তুমি ওর কাছে জাদুর আয়না সিপাও-কে
চাও। ও দিতে চাইবে না, কিন্তু তুমি কিছুতেই হাল ছাড়বে না, বারবার তুমি অনুরোধ জানাতে
থাকবে। তুমি ওর প্রাণ রক্ষা করেছ। অবশেষে সে তোমাকে ওটা ঠিকই দেবে। ওটা একটা অমুল্য
জিনিস। ঐ আয়না হলো ইচ্ছা পূরণের আয়না।
পরদিন দেখা গেল, বোতলটি ঠিকই বলেছে। সর্পরাজ শিকারিকে
সিপাও আয়নাটির পরিবর্তে অনেক কিছু দিতে চাইল কিন্তু শিকারির ঐ এক কথা। তার প্রতিশ্রুত
পুরস্কার হিসেবে সে ঐ আয়নাই নিবে।
অবশেষে জলভরা চোখে সর্পরাজ ইনসাটো বলল, ‘আমি কখনই ভাবিনি যে তুমি আমার ঐ জাদুর আয়নাটিই চেয়ে বসবে। যাই হোক, কথা যখন দিয়েছি আমি আমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবো। এই নাও জাদুর আয়না সিপাও। তারপর ওটা হাতে নিয়ে বল, সিপাও, আমাকে আমার স্বদেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাও। তখন তুমি নিজেকে তোমার নিজের দেশে দেখতে পাবে।’
পৃষ্ঠা ২/ ৪
সিপাও আয়নাটি হাতে নেয়ার পর শিকারি তাই করলো এবং সঙ্গে
সঙ্গে সে নিজেকে পৃথিবীর বুকে ঘন অরণ্যের মধ্যে দেখতে পেল কিন্তু ঠিক কোথায় তা বুঝতে
পারলো না। তখন সে আবার বলল, ‘সিপাও, সিপাও, তুমি আমাকে আমার নিজের কুটিরের পথে
নিয়ে যাও।’
দেখতে দেখতে শিকারি নিজেকে ঐ পথে আবিষ্কার করল। একটু
পরেই শিকারি তার কুটিরে পৌঁছে গেল। শিকারি দেখল যে তার স্ত্রী ও কন্যা তার জন্য শোক
করছে। ওরা ধরে নিয়েছিল যে শিকারের সময় সে বোধহয় সিংহের পেটে গেছে। তাকে সশরীরে, সুস্থ
দেহে ঘরে ফিরতে দেখে ওদের খুশি আর ধরে না।
শিকারি জাদুর আয়নাটি হাতে নিয়ে এবার বলল, ‘সিপাও সিপাও, আমি সর্পরাজ ইনসাটোর
নগরের মতো একটি নগর চাই। আমি এই নগরের প্রভু হব।’
সঙ্গে সঙ্গে বিশাল জাম্বেসি নদীর তীরে একটা নগর গড়ে
উঠল। সেখানে দেখা গেল সারি সারি পাথরের বাড়ি। বাড়িগুলোর ছাদ যেন সোনার পাতে মোড়া, লোকজনের
গোলাঘর শস্যে পূর্ণ, গোয়াল ঘরে দুধেল গরু, বাথানে তেজীয়ান মহিষ।
শিকারির স্ত্রী ও কন্যা এসব কেমন করে হলো সে রহস্য
জানবার জন্যে ভীষণ পীড়াপীড়ি করতে শুরু করে। শিকারি বহুদিন তাদের অনুরোধ-উপরোধে কর্ণপাত
করেনি কিন্তু শেষ পর্যন্ত জাদুর আয়নার কথা প্রকাশ করে দিয়ে কন্যাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
শোনো মা! আমার মনে হয় সিপাও তোমার কাছে আমার চাইতে নিরাপদে থাকবে। আমি নানা জায়গায়
যাই, কখন কি হয় বলা যায় না।
শিকারির কন্যা জাদুর আয়না তার বালিশের নিচে সাবধানে
লুকিয়ে রাখে। সুখে-শান্তিতে তাদের দিন কাটে। এমনিভাবে বেশ কয়েক বছর অতিক্রম হয়। একসময়
বয়সের ভারে শিকারির মাথার সব চুল সাদা হয়ে যায়, আর তখন একদিন সশস্ত্র সাদা মানুষের
দল তার দেশ জয় করে নেবার উদ্দেশ্যে সেখানে আক্রমণ করে বসে। কিন্তু জাদুর আয়নার সাহায্যে
শিকারি ও তার লোকেরা সাফল্যের সঙ্গে সাদা মানুষের আক্রমণ প্রতিহত করে। সাদা মানুষেরা
সমুদ্র উপকূলে পালিয়ে যায়।
এই পরিস্থিতিতে শ্বেতাঙ্গদের অধিপতি ‘রেই’ কৃষ্ণাঙ্গদের শক্তির উৎস কোথায়
তা আবিষ্কার করার জন্য তার এক বিশ্বস্ত ও চতুর অনুচরকে ছদ্মবেশে তাদের কাছে পাঠালো।
ঐ লোক ছেঁড়াপুড়া কাপড় পরে কান্না কান্না মুখ করে শিকারির কাছে এসে বলল, মান্যবর, আমাকে দয়া করুন। আমার বাড়ি নেই, ঘর নেই, কিছুই নেই। আমি আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে রাজি হয়নি, সে অপরাধে ‘রেই’ আমার সবকিছু কেড়ে নিয়ে উপোস করে মারার জন্য আমাকে জাঙ্গলে পাঠিয়ে দিয়েছে। আমি জানি বিশাল জাম্বেসি নদীর মতো আপনার শক্তি। আপনি আমায় একটা উপায় করে দিন।
পৃষ্ঠা ৩/ ৪
বৃদ্ধ শিকারি সাদা মানুষটার কথা বিশ্বাস করে দয়াপরশ
হয়ে তাকে থাকার জন্য একটা বাড়ি করে দিল এবং তার ভরণপোষণেরও ব্যবস্থা করলো। কিন্তু সাদা
মানুষদের ঐ ধূর্ত অনুচর শিকারির মেয়েকে ভালো ভালো কথায় ভুলিয়ে তার আস্থা অর্জন করলো।
শিকারির মেয়ে তাকে জাদুর আয়নার কথা বলে দেয় এবং তাকে আয়নাটা দেখায়।
ধূর্ত ও বিশ্বাসঘাতক সাদা লোকটি আয়নাটা তার হাতে নিয়েই
বলল, সিপাও সিপাও! আমি এক্ষুনি ‘রেই’ এর কাছে যেতে চাই। একথা বলার সঙ্গে
সঙ্গে শিকারির কন্যার সামন থেকে সে অদৃশ্য হয়ে যায়। দেখতে দেখতে সাদা মানুষের দল আবার
শিকারির শহর আক্রমণ করল। শিকারি তার মেয়ের কাছে ছুটে এসে বলল, শিগগির আমার জাদুর আয়নাটা
আমাকে দাও।
মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘ঐ আয়না আর আমার কাছে নেই, বাবা।
বন্ধুত্বের ভান করে ঐ সাদা লোকটি আয়নাটা আমার কাছ থেকে চুরি করে নিয়ে পালিয়ে গেছে।’
শিকারি তখন তার বেতের ঝুড়ির মুখ খুলে বলল, ‘জেংগি-মিজি, বলে দাও এখন আমি কি
করতে পারি।’
জেংগি-মিজি ভোঁ ভোঁ করে বলল, ‘তোমার আর কিছুই করার নেই। তুমি
যে হরিণটিকে হত্যা করেছিলে তার কথা এখন সত্য হতে চলেছে।’
হ্যাঁ হ্যাঁ, হরিণ বলেছিল যে, আমার পুরস্কারই আমার
ও আমার জনগণের জন্য অশেষ দুর্দশা ডেকে আনবে, আর তাই এখন ঘটছে।
সাদা মানুষেরা অবশেষে কালোদের পরাজিত করে শহর দখল করে নেয়। দখলেই শেষ হয়না পুরো ঘটনা। হত্যা করতে থাকে কালোদের। কালো যত নারী, পুরুষ, শিশু-কিশোর সকলকে হত্যা করতে থাকে। সাদাদের কাছে পরাজিত কালোরা কোথাও দাস, কোথাও ক্রীতদাস হয়ে বেঁচে থাকে।
***** সমাপ্ত *****
পূর্বের পোষ্ট: ক্ষেতমজুর উলান বাতোরের গল্প (মঙ্গোলিয়ার লোককাহিনী) || লোককাহিনী - ১৪
পরবর্তী পোষ্ট: রহস্যময় তিনটি হাসি (আয়ারল্যান্ডের লোককাহিনী) || লোককাহিনী - ১৬
‘লোককাহিনী’ ক্যাটাগরির জনপ্রিয় গল্পসমূহ
◉ চুলার উপর টাকা (আফগানিস্তানের লোককাহিনী)
◉ একটা ব্যাঙের গল্প (তিব্বতের লোককাহিনী)
◉ মানসিক আঘাতের বেদনা (তাজাকিস্তানের লোককাহিনী)
◉ হলদে ঝুঁটির মোরগটি (রাশিয়ার লোককাহিনী)