সারমর্ম: আধুনিক পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক রহস্যময় অরণ্য যেটিতে ঘটে গিয়েছিল কয়েকটি রহস্যময় ঘটনা যেগুলোর কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেন ঘটেছিল ওসব ঘটনা, বিশেষজ্ঞদের অভিমতই বা কি ছিল, জানতে পড়ুন। মোট- ৪ পৃষ্ঠা
প্যারানরমাল গল্প লেখক জোসেফ এ সিত্রো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিম
ভারমন্টে অবস্থিত রহস্যজনক এক স্থানের নাম দেন ‘বেনিংটন ট্রায়াঙ্গল’। অরণ্যে ঘেরা
এই অঞ্চলটি এখনো অনেকের কাছেই রহস্যময়, এখানে প্রায়ই ঘটে থাকে রহস্যজনক সব ঘটনা।
এই অরণ্যে ঢুকলেই কেউ হয়তো শুনতে পায় অদ্ভুত সব আওয়াজ, কেউবা আবার বনের
মধ্যে পথ হারিয়ে আর ফিরে আসে না, আবার কেউ হয়ে পড়ে বদ্দ উন্মাদ। স্থানীয় অনেকেই মনে করেন,
স্থানটিতে নাকি এক অশুভ শক্তির প্রভাব আছে- তার ফলে ঘটেছে একের পর এক রহস্যজনক নিখোঁজ
ও মৃত্যুর ঘটনা।
রহস্যময় অরণ্য বেনিংটন ট্রায়াঙ্গল
১৮৯২ সালে এলাকাটির রহস্যময়তার প্রথম সূত্রপাত ঘটে বলে অনেকেই মনে করে
থাকেন। এ সময় হেনরি ম্যাকডওয়েল নামের এক স্থানীয় মাতাল জিম ক্রাউলি নামের এক কারখানার
শ্রমিককে হত্যা করে। বিচারে ম্যাকডওয়েলকে উন্মাদ ঘোষণা করা হয় এবং ভারমন্ট স্টেট
হসপিটালের ওয়াটারবেরি অ্যাসাইলামে পাঠানো হয়, কিন্তু তার আগেই সে জেলখানা থেকে নিখোঁজ
হয়ে যায়। তাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি এমনকি তার লাশও পাওয়া যায়নি। এই ঘটনার মধ্য
দিয়েই বেনিংটন ট্রায়াঙ্গল এর রহস্যময়তার সূচনা হয়।
এর প্রায় ৩০ বছর পর একের পর এক রহস্যময় ঘটনা ঘটতে শুরু করে। ১৯২০ থেকে
১৯৫০ সালের মধ্যে বেনিংটন ট্রায়াঙ্গলে ঘটেছিল এমন কয়েকটি নিখোঁজের ঘটনা, যার রহস্যভেদ
করা এখনো কোন সার্চ টিম বা তদন্তকারী কর্মকর্তার পক্ষে সম্ভব হয়নি।
কিভাবে একের পর এক এসব নিখোঁজের ঘটনা ঘটেছিল, চলুন তাহলে এবার তা জেনে
নেয়া যাক।
প্রথম ঘটনা
প্রথম যে ঘটনায় বেনিংটন ট্রায়াঙ্গল তোলপাড় হয়, তা আজ থেকে অনেক বছর আগের কথা, ১৯৪৫ সালের ২ নভেম্বরের ঘটনা। মিনি রিভার্স নামের ৭৫ বছর বয়সী একজন গাইড ৪ জন শিকারীকে নিয়ে পাহাড়ে গেলেন শিকারের উদ্দেশ্যে।
দলটিকে নিয়ে ফিরে আসার সময় লং ট্রেইল রোড ও ৯ নম্বর রুটের কাছাকাছি এসে গাইড রিভার্স তার সহযাত্রীদের থেকে সামান্য এগিয়ে যান। এরপর থেকে তার সহযাত্রীরা তার আর কোন হদিসই পাননি। হঠাৎই ওই জায়গা থেকে তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। পরে স্থানীয় পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকের দল চিরুনি অভিযান চালিয়েও রিভার্সের দেখা তো দূরে থাক, তার দেহ পর্যন্ত খুঁজে পায়নি।
পৃষ্ঠা ১/ ৪
দ্বিতীয় ঘটনা
পরের ঘটনাটি ঘটে প্রায় এক বছর পর। ১৯৪৬ সালের ১ ডিসেম্বর। বেনিংটন কলেজে অধ্যয়নরত পলা ওয়েল্ডেন নামের ১৮ বছরের যুবতী ভ্রমণের নেশায় লং ট্রেইলের উদ্দেশ্যে বেনিংটন ট্রায়াঙ্গলের বনের মধ্যে ঢুকে পড়েন। তার পরনে ছিল উজ্জ্বল লাল রঙ্গের জ্যাকেট আর তার পরিচিত অনেকেই তাকে বনের মধ্য দিয়ে যেতে দেখেছে। কিন্তু সে আর জঙ্গল থেকে কখনো ফিরে আসেনি।
এরপর তাকে খুঁজে দেওয়া বা তার সন্ধান দেয়ার জন্য ৫,০০০ ডলারের পুরস্কার
ঘোষণা করা হয়। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের তদন্ত সংস্থা এফবিআই এর সাহায্য নেওয়া হয়। কিন্তু
কোনভাবেই তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে তাকে নিয়ে এমন গুজব ছড়ায় যে, পলা হয়তোবা তার
প্রেমিকের সাথে কানাডায় চলে গেছে। আরেকটি ধারণাও তখন বেশ প্রচলিত ছিল, আর তা হচ্ছে
প্রকৃতির মাঝে একাকী নিরিবিলি জীবনযাপনের জন্য নির্জন জঙ্গলকে বেছে নিয়েছে পলা। কিন্তু
এর সপক্ষে কোন বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
তৃতীয় ঘটনা
তৃতীয় ঘটনাটি ঘটে তার ৩ বছর পর, ১৯৪৯ সালের ১ ডিসেম্বর তারিখে। জেমস ই
টেটফোর্ড নামের একজন প্রবীণ সামরিক ব্যক্তি তার এক আত্মীয়ের সাথে দেখা করার জন্য সেইন্ট
এলবান থেকে বাসে করে বেনিংটনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। বাসে যাত্রী ছিলেন মাত্র
১৪ জন। কিন্তু বাস গন্তব্যস্থলে পৌঁছার পর দেখা গেল, জেমস বাসে নেই! বাসযাত্রীদের তথ্যমতে,
বাসটি কোথাও যাত্রাবিরতি করেনি। কিন্তু সেইন্ট এলবান থেকে বাস যখন যাত্রা শুরু করে,
তখন বাস ড্রাইভারসহ যাত্রীরা জেমসকে তার নির্ধারিত সিটে বসতে দেখেছে। বাস চলা শুরু
করলে তিনি তার সিট থেকে একবারও ওঠেননি। আবার কয়েকজন যাত্রী শেষ স্টপেজের আগের স্টেশন
পর্যন্ত জেমসকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখেছেন বলে জানান। কিন্তু তারা কেউই বলতে পারলেন না,
জেমস কোথায় হারিয়ে গেছেন। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, জেমসের লাগেজ ব্যাগসহ তার টাকা ভর্তি
মানিব্যাগটি তার আসনে পড়ে থাকতে দেখা যায়।
চতুর্থ ঘটনা
পরের ঘটনাটি ঘটে পল জেপসন নামের এক আট বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে। ১৯৫০ সালের ১২ অক্টোবরের এক সকালের ঘটনা। জেপসন ছিল তার মায়ের সাথে। তার মা ঐ সময় শুকরছানাদের খাবার খাওয়াচ্ছিলেন, আর জেপসন বাড়ির চারপাশে ছোটাছুটি করছিল। ঘন্টাখানেক পর মা ঘরে এসে দেখেন, জেপসন ঘরের আশেপাশে কোথাও নেই। জেপসনের গায়ে ছিল লাল রঙের জ্যাকেট, দূর থেকেও যা সকলের চোখে পড়ার কথা। কিন্তু সার্চ টিম অনেক অনুসন্ধান করেও তাকে আর উদ্ধার করতে পারেনি।
পৃষ্ঠা ২/ ৪
পঞ্চম ঘটনা
তারিখটি ছিল অক্টোবর ২৮, জেপসনের ঘটনার মাত্র ১৬ দিন পর। ৫৩ বছর বয়সী ফ্রিডা ল্যাঙ্গার ও তার চাচাতো ভাই হার্বার্ট এলনসার সমারসেট ক্যাম্পিংয়ের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন রিজার্ভেরারের কাছে। হঠাৎই একটি ছোট স্রোতের নদী পার হতে গিয়ে ফ্রিডা পানির মধ্যে পড়ে যান, ভিজে যায় তার পরনের কাপড়-চোপড়।
এরপর তিনি হার্বার্টকে একটু অপেক্ষা করতে বলেন। পোশাক পরিবর্তনের জন্য
ফ্রিডা ফিরে যান ক্যাম্পে। অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরও তিনি আসছেন না দেখে হার্বার্ট ক্যাম্পে
ফিরে আসেন। কিন্তু হার্বার্ট ক্যাম্পে ফিরে এসেও ফ্রিডাকে খুঁজে পাননি। এলাকাটি ফ্রিডার
কাছে বেশ পরিচিত, ফলে দিনের আলোয় হারিয়ে যাওয়া তার পক্ষে বেশ অসম্ভবই বটে। আবার শুরু
হলো ব্যাপক তল্লাশি। দুই সপ্তাহ ধরে ৩০০ জন অনুসন্ধানকারীর সমন্বয়ে গঠিত ৫টি অনুসন্ধান
টিম হেলিকপ্টার, এয়ারক্রাফট থেকে শুরু করে বিভিন্নভাবে তন্নতন্ন করে অনুসন্ধান চালিয়েও
ফ্রিডার অস্তিত্ব কোথাও খুঁজে পায়নি।
তবে অদ্ভুত এক ব্যাপার হলো, এই ঘটনার এক বছর পর, ১৯৫১ সালের ১২ মে সমারসেট
রিজার্ভের কাছাকাছি এক জায়গায় ফ্রিডার মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু তার দেহ ময়নাতদন্ত
করেও মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যায়নি। তবে ফ্রিডাই ছিলেন একমাত্র নারী যার লাশটি খুঁজে
পাওয়া গিয়েছিল।
কেন ঘটছে একের পর এক এই অদৃশ্য
হওয়ার ঘটনা?
অনেক প্যারানরমাল বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে তাদের নানা অভিমত উপস্থাপন করেছেন।
নেটিভ আমেরিকানরা গ্লসটেনবারি মাউন্টেনের আশেপাশের এলাকাটি ‘অভিশপ্ত ভূমি’ বলে মনে করেন। এলাকাটিতে বসবাস স্থাপনকারী প্রথম ইউরোপীয় অধিবাসীদের
এক অংশের অভিমত এই যে, ’পাহাড়ের পেছনের
আকাশে প্রায় সময়ই এক অদ্ভুত আলোর ঝলকানি দেখা যায়। বাতাসে ভেসে বেড়ায় এক মাদকতাময় গন্ধ
আর মাঝে মাঝে শোনা যায় নানা অদ্ভুত ধ্বনি।’
স্থানীয় কারো কারো মতে, এক বিশাল দৈত্যাকার প্রাণীর বাস রয়েছে জঙ্গলটিতে।
এই প্রাণীটির আকস্মাৎ আক্রমণের শিকার হয় অভিযাত্রীরা।
অনেক প্যারানরমাল বিশেষজ্ঞের মতে, স্থানটিতে বাস্তব চেনা ত্রিমাত্রিক
জগতের প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটে, যার ফলে কেউ এই জগতে প্রবেশ করতে গেলে সে দিকভ্রান্ত
হয়ে হারিয়ে যায়। আবার অনেকের মতে, ভিন্ন গ্রহের প্রাণীদের অবস্থান রয়েছে এই বেনিংটন
ট্রায়াঙ্গল জঙ্গলে, তাদের কারনেই ঘটছে এসব অস্বাভাবিকতা।
আরেকটি মত হচ্ছে, কোন সিরিয়াল খুনি বনের মধ্যে বসতি গড়ে আছে, সে-ই এই সব খুনের পেছনে দায়ী। বিষয়টি যদি সত্যি হয়, তাহলে একটি প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়ায় যে, এতগুলো হত্যাকাণ্ডের কোনো হদিস কেন পাওয়া গেল না। একটি ছাড়া কেন পাওয়া গেল না আর কোন মৃতদেহ।
পৃষ্ঠা ৩/ ৪
এরপরও এমন আরও কিছু তথ্য এসব অদৃশ্য ঘটনার পেছনে পাওয়া যায়, যেগুলো বেশ
রোমাঞ্চকর। যেমন-
১. সবগুলো হত্যাকাণ্ড একটি বিশেষ সময়ে অর্থাৎ শীতকালে ঘটেছে। শীতের সময়
ছাড়া বছরের অন্য সময়ে কেন এমন কিছু ঘটে না?
২. ১৯৪৫ থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে অদৃশ হওয়ার এসব ঘটনাগুলো ঘটেছে।
৩. ফ্রিডা ছাড়া আর কারো কোন হদিস শেষপর্যন্ত পাওয়া যায়নি। কিন্তু কিভাবে
ফ্রিডা তার তাঁবু থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল, সেটিই একটি রহস্য।
৪. হারিয়ে যাওয়ার পর অনুসন্ধান দল তন্নতন্ন করে খুঁজেও ফ্রিডার কোন হদিস
পায়নি। অথচ এক বছর পর যে জায়গা থেকে তিনি হারিয়ে গিয়েছিলেন সেখানেই তার লাশ পাওয়া যায়,
যা এক বড় রহস্য।
৫. ফ্রিডা এবং রিভার্স দু’জনই বয়স্ক ব্যক্তি ছিলেন এবং এলাকাটি তাদের নখদর্পনে ছিল। তাই পথ হারিয়ে
ফেলা তাদের পক্ষে একবারেই অসম্ভব।
৬. অপর দুই ভিকটিম ওয়েল্ডেন ও জেপসন উজ্জ্বল লাল জ্যাকেট পরিহিত ছিল।
ফলে অনেক দূর থেকে তাদের দেখতে পাওয়া যাওয়ার কথা। কিন্তু তাদের পরিহিত কোন কাপড় পর্যন্ত
পাওয়া যায়নি।
৭. আবার ওয়েল্ডেন ও ট্রেডফোর্ড এই দুই ভিকটিম তিন বছরের ব্যবধানে একই
তারিখে অদৃশ্য হয়ে যান, যা বেশ কাকতালীয়।
১৯৩৭ সালের পূর্বে এলাকটি বেশ জনবহুল ছিল। কিন্তু ১৯৩৭ সালের দিকে গ্লসটেনবুরি শহরে প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও মহামারি দেখা দেয়, ফলে অনেক লোকের প্রাণহানি ঘটে। সে সময় নগরটি পরিত্যক্ত হয়। ২০১০ সালের একটি আদমশুমারীর তথ্য অনুযায়ী, এই এলাকাটিতে সব মিলিয়ে মাত্র আটজন বাসিন্দা বাস করে। বর্তমানে এটি ভূতুড়ে শহর হিসেবেই পরিচিত।
***** সমাপ্ত *****
পূর্বের পোষ্ট: রাজপ্রাসাদের সেই মুণ্ডুহীন ভূত || ভূতের গল্প ১০
পরের পোষ্ট: নোয়াখালীর সেই বাংলো || ভুতের গল্প - ১২
‘ভূতের গল্প’ ক্যাটাগরির জনপ্রিয় গল্পসমূহ