আষাঢ় মাস। ক’দিনের একটানা বৃষ্টি এবং উজানের পানি নামতে থাকায় খাল বিল পানিতে একাকার। বিলের ফসলি ধানি জমিতে পানি ঢুকে পড়ায় ফসল কাটতে ব্যস্ত সময় কাটায় কৃষকেরা। প্রতি বছরই এ গ্রামে পানি আসে। নিচু এলাকা হওয়ায় বিলগুলো পরিনত হয় সাগরে। বিশাল জলরাশির ফাঁকে ফাঁকে বাড়ির ভিটেগুলো মাথা উঁচু করে থাকে। ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজ মুখো হয় না। প্রায় বাড়িতেই একটা দুটো ডিঙ্গি নৌকা থাকে। এ সময়টাতে খালে বিলে মাছ ধরে, শাপলা-শালুক কুড়িয়ে, বিলের পানিতে ঝাপাঝাপি করেই সময় কাটায় গ্রামের ছেলেমেয়েরা।
খালের নতুন পানিতে পুঁটি, খোলসে, চিংড়ি, শোল-টাকিমাছের
ঝাঁক বেঁধে ছুটে চলা। খেয়াজালে উঠে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে পুঁটি, খোলসে, টাকিমাছের দল। খালের
পানিতে মাছ ধরার উৎসব শুরু হয়ে যায় যেন। রাতের বেলা ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকায় চেপে বিলে
মাছ ধরতে লেগে যায় সৌখিন মাছ শিকারিরা। অন্ধকার রাতের তারার মতো মাছ শিকারিদের হ্যারিকেনের
টিমটিমে আলোয় অসাধারণ রুপ নেয় বিলটি। গ্রামের এ দৃশ্যটা প্রতি বছরের। এ গ্রামে বর্ষা
যেন উৎসবের আমেজ নিয়ে আসে।
ওসমান আর নাজিম এ গ্রামেরই ছেলে। গ্রামের আলো বাতাসে
বেড়ে উঠেছে দুজন। বর্ষা এলে ওদেরও মনটা আনচান করে উঠে। নাজিম খালের পানিতে মাছ ধরে।
রাতে বাড়ির পাশের তলিয়ে যাওয়া ধানক্ষেতের আলের উপর কৈয়াজাল পেতে রাখে। খুব ভোরে গিয়ে
জাল তুলে আনে। প্রতিদিনই কিছু না কিছু কৈ, টাকি, বাইল্যা, কাইখ্যামাছ জালে আটকা পড়ে।
শুধু মাছই নয়, মাঝে মাঝে ধোড়াসাপও জালে উঠে আসে। প্রথম প্রথম একটু আধটু ভয় পেলেও এখন
আর ভয় পায় না নাজিম।
রাতে নৌকায় করে বিলে মাছ ধরার ওসমানের প্রস্তাবে রাজি
হয়ে যায় নাজিম। রাজি না হয়ে উপায়ও নেই। এ গ্রামে ওসমানই নাজিমের একমাত্র ঘনিষ্ট বন্ধু।
ও যেমন সাহসি তেমনি একরোখা। রাজি না হলে বন্ধুত্বই নড়বড়ে হয়ে যাবে। তাছাড়া রাতের বিলের
সৌন্দর্য উপভোগের এমন মোক্ষম সুযোগটাও হাতছাড়া করতে চায় না ও। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে মায়ের
কাছে অনুমতি চাইলে মায়ের রক্তচক্ষু দেখে আর বলার সাহস পায়নি নাজিম।
ওসমানের পরিকল্পনা মত বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেলে দরজায়
তিন টোকা দেয়ার শব্দ পেয়েই আলতো হাতে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে নাজিম। বাড়ির পাশেই তলিয়ে
যাওয়া ধানক্ষেতে ওসমানের ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে বসে। ওসমান বিলের মাঝ বরাবর বাঁশের লগি ঠেলে
নৌকা চালাতে থাকে। বিলে এক কোমর পানি। ঝাকিজাল আর কৈয়াজাল নিয়ে এসেছে ওসমান। বিলের
মাঝে ফাঁকে ফাঁকে মিটিমিটি তারার মত হ্যারিকেনের আলো জ্বলছে। চারদিকে সুনসান নিরবতা।
লগি উঠানামায় কেবল পানির ছপছপ শব্দ। ঠান্ডা ঝিরিঝিরি বাতাসে হৃদয় মন জুড়িয়ে যাচ্ছে।
পৃষ্ঠা ১
ওসমান নিরাপদ জায়গায় নৌকা দাঁড় করায়। ছোট ছোট বাঁশের খুটার সাথে বেঁধে কৈয়াজাল পাতে। ওসমানের কথামত নাজিম কেয়াজালের আশেপাশে নৌকা চালাতে থাকে। ওসমান ঝাকিজাল ফুলের মত ছড়িয়ে পানিতে ফেলতে থাকে। ওসমানের মতে এতে না কি দুটো লাভ, ঝাকিজাল থেকে বেরিয়ে যাওয়া মাছগুলো পালাতে গিয়ে কৈয়াজালে আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
লতাপাতা ময়লা আবর্জনার পাশাপাশি ছোট বড় মাছ উঠতে লাগল।
একবার জাল পরিষ্কার করতেই লেগে যায় অনেকটা সময়। রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে মাছের সংগ্রহও
বাড়তে লাগল। ঘুমে আর ক্লান্তিতে দুচোখ ঢুলুঢুলু করছে। কৈয়াজাল উঠিয়ে পাওয়া গেল ত্রিশ/চল্লিশটা
কৈ মাছ। সব মিলিয়ে দশ/বারো কেজি মাছ হয়েছে। ওসমান বলল- ‘আজ আর পারছি না, চল চলে যাই। কাল
আবার আসব।’
সকালে মার হাতে মাছ তুলে দেয়ায় মায়ের হালকা বকুনি শুনে নাজিমের মনে হলো- মা রাগ করলেও ততটা নয়। আজ রাতে আবার মাছ ধরতে যাওয়া যাবে।
গতকালের ক্লান্তিতে বিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল নাজিম।
দরজায় ঠকঠক টোকা দেয়ার শব্দ শুনেই হতচকিয়ে উঠে। কোন শব্দ না করে চুপি চুপি বেরিয়ে যায়
ওসমানের সাথে। ওসমান আজ বেশ জোরে জোরে হাঁটছে। আজ দেরি হয়ে যাওয়ায় সম্ভবত। নাজিম ওসমানকে
অনুসরণ করে। ওসমান যথারীতি নৌকা চালায়। গতকাল যেখানটায় মাছ ধরেছে আজ সেখানটায় না গিয়ে
একটু দূরে গিয়ে নৌকা থামায়। পাশেই মাথা উঁচু করে আছে ঝাঁকড়া পাতার তেঁতুল গাছ। গাছের
কাণ্ড পানিতে ডুবে আছে। গতকালের মত ওসমান জাল পাতে। ঝাকিজাল ছড়িয়ে দিতে থাকে এদিক ওদিক।
জাল টেনে তুলে। নাজিম জাল পরিষ্কার করে মাছ নামায়। এ দিকটায় গাছের ছায়ার কারণে কি না
কে জানে, আজ বেশ মাছ ধরা পড়েছে। নাজিম মাছ ছাড়িয়ে নৌকার পাটাতনে রাখে।
ওসমান আজ অনেকটাই নিরব। কোন কথাবার্তা বলছে না। চুপচাপ
একমনে জাল মেরে যাচ্ছে। টুকটাক প্রশ্ন করেও তেমন কোন উত্তর না পেয়ে নাজিমও একমনে জাল
পরিষ্কার করতে থাকে। নাজিম লক্ষ্য করলো নৌকার পাটাতনে কিছুক্ষণ আগেও অনেক মাছ ছিল।
এখন মাছ কম মনে হচ্ছে। কি জানি, মাছগুলো পাটাতনে ছড়িয়ে গেছে কি না।
ওসমান জাল তুলে নাজিমকে পরিষ্কার করতে দিয়ে পাটাতনে মাছের কাছে গিয়ে বসে। নাজিম মাছ ছাড়াতে থাকে। ওসমানের নিরবতার কারণে আগ বাড়িয়ে কোন কথা বলছে না নাজিম। একমনে কাজ করতে থাকে। নাজিম শুনতে পেল কেউ যেন কুকুরের হাঁড় চিবানোর মত শব্দ করে কিছু খেয়ে যাচ্ছে।
পৃষ্ঠা ২
নাজিমের বুকটা ধক করে উঠে। না, ওসমান নির্বিকার বসে
আছে। মুখ ফিরিয়ে নিতেই আবার শব্দটা শুনতে পেল নাজিম। মনে হলো কে যেন মাছ খাচ্ছে। ওসমান
মাছ খাচ্ছে না তো! ওসমানকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে যায়। আবার না ওসমান নাজিমকে ভীতুর
ডিম ভেবে বসে। কিন্তু একসময় নাজিম বুঝতে পারে ওসমানই কচকচ করে মাছ খাচ্ছে। এ মুহূর্তে কি করা উচিত
কিছুই ভেবে পাচ্ছিল না নাজিম।
ময়লা পরিষ্কার করতে গিয়ে হঠাৎ চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে ওসমানের কাছে চলে আসে নাজিম। ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে নাজিম।
‘কি হয়েছে?’ প্রশ্ন করে ওসমান।
নাজিম ভয়ে কাঁপছে। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুতে চাইছে না।
ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলে- ‘একটা বাচ্চা ছেলের লাশ!’
ওসমানের তেমন কোন ভাবান্তর হলো না বলেই মনে হলো নাজিমের।
ওসমান বলল- ‘বেঁচে আঁছে নাঁ মঁরে গেঁছে? দেঁখ
বেঁচে আঁছে কিঁ নাঁ।’
নাজিম কাঁপা কাঁপা পায়ে এগিয়ে যায়। দেখে দুই আড়াই
বছরের একটা বাচ্চা ছেলে।
পেটটা বিশ্রি রকমের ফুলে আছে। নিথর দেহ। নাজিম মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখল ওসমান নির্বিকার
বসে আছে। একমনে কাঁচা মাছ চিবিয়ে যাচ্ছে। আবার বলল-
‘নাঁকের কাঁছে কাঁন দিঁয়ে শোঁন, শ্বাঁস-প্রঁশ্বাসের শঁব্দ পাঁওয়া যাঁয় কিঁ
নাঁ। কাঁপুরুষের মঁত বাঁচ্চাটাকে ফেঁলে যাঁওয়া ঠিঁক হঁবে নাঁ। কীঁ বঁলিস।’
ওসমানের কাণ্ড দেখে ভীষণ রাগ হচ্ছিল নাজিমের। এ কি
সেই ওসমান! না কি অন্য কেউ ওসমানের বেশ ধরে আছে! অমন নাকি গলায় কথা বলছে কেন ও? কিছুই
ভাবতে পারছে না। বাচ্চাটার নাকের কাছে কান দিয়ে শোনার চেষ্টা করে। মুখের কাছে কান লাগাতেই
লাশটা কথা বলে উঠে। স্পষ্ট শুনতে পায় নাজিম। লাশটা বলছে- ‘আঁমাকে মাঁছ দেঁ, আঁমি মাঁছ খাঁবো।
আঁমরা মেঁছো ভূঁত।’
তড়াক করে লাফিয়ে উঠে নাজিম। নাজিমকে লাফিয়ে উঠতে দেখে ওসমান মিটিমিটি হাসতে থাকে। বাচ্চাটা দিব্যি হেঁটে হেঁটে নাজিমের দিকে এগিয়ে আসে। বলে- ‘আঁমাদের এঁলাকায় মাঁছ ধঁরবি, আঁমাদেরকে মাঁছ দিঁবি নাঁ তাঁ কিঁ হঁয়?’
নাজিম ভয়ে চিৎকার করে উঠে- ‘কে আছেন, বাঁচান।’
নাজিম জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। আশেপাশের মাছ শিকারিরা চিৎকার
শুনে নাজিমকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করে বাড়ি পৌছে দেয়।
প্রচণ্ড জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে নাজিমের। খবর পেয়ে ওসমান
নাজিমকে দেখতে আসে। ওসমানকে দেখে নাজিমের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে। বলে- ‘কাল রাতে মাছ ধরতে গিয়ে আমাকে ভয়
দেখালি কেন?’
ওসমান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। বলে- ‘কাল রাতে তো তোর কোন সাড়াশব্দ না
পেয়ে বাড়ি ফিরে গেছি। কাল তো আমি মাছ ধরতে যাই-ই নি!’
নাজিম ভাবতে থাকে- কাল তবে কার সাথে মাছ ধরতে গিয়েছিল! ও কি তবে ভূত ছিল! কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারে না।’
নাজিম এখন ভার্সিটিতে পড়ে। বর্ষা এলে মাঝে মাঝে বাড়ি আসে। মাছ শিকারের কথা ভাবতে গেলেই গা শিউরে উঠে ওর।
***** সমাপ্ত *****