সারমর্ম: সৎ দুই বড়বোনের নিষ্ঠুর আচরণ ও শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সিলডারেলা নামের সেই ছোট্ট সুন্দরী মেয়েটি যেভাবে হঠাৎ করে একদিন রাজকুমারী হয়ে গেল। মোট- ৭ পৃষ্ঠা
ফ্রান্স ইউরোপ মহাদেশের দেশ হলেও দুনিয়ার মানুষের
কাছে তার খুব কদর আছে রাজধানী প্যারিস শহরের অপরূপ সৌন্দর্যের জন্য। সেই ফ্রান্সের
এই লোকগল্পটি দুনিয়ার সব শিশু-কিশোরই জানে।
সেই সময়ে ফ্রান্সের একটি শহরে রাজপ্রাসাদের কাছাকাছি
একটি বাড়ি ছিল। এ বাড়িতে বাস করতো এক ভদ্রমহিলা ও তার তিন মেয়ে। বড় দুই বোন দেখতে খুব
সুন্দর নয়। তারা ছিল খুব অহংকারী আর অলস। সারাক্ষণই বিরক্তিতে তারা কপাল কুঁচকে রাখত।
এর কারণ তাদের ছোট বোন সিনডারেলা ছিল তাদের সৎবোন।
কিন্তু সিনডারেলা দেখতে ছিল অপূর্ব সুন্দরী। সে ছিল
যেমন অমায়িক তেমনই কর্মচঞ্চল। বড় দুবোন বাস করতো দোতলায় ছিমছাম, আরামদায়ক ঘরে। ছোট
বোনের বাস ছিল স্যাঁতস্যাঁতে রান্নাঘরে। রান্না করা, বাসনকোসন ধোয়া, শাকসবজি কাটা,
অন্যদের বিছানা-বালিশ ঠিক করে দেয়া, তাদের কাপড়চোপড় ধোয়া, শুকিয়ে গেলে ভাজ করে ঠিকঠাকমতো
রাখা- এসব ছিল তার সারাদিনের কাজ।
মেয়েটিকে খুব ভোরবেলা উঠতে হতো। বরফ জমা ঠাণ্ডায় কাজ
করতে করতে হাত-পা জমে আসতো তার। কিন্তু সৎমার কাছে থাকতে হলে কাজ না করে উপায় কি!
এতকিছু করেও সে মন পেত না কারো বরং অত্যাচার সহ্য
করতে হত। সকালে উঠে প্রথমে সে প্রার্থনা করত। তারপর তার ঘন চুল আঁচড়িয়ে গুনগুন করে
গান গাইতে গাইতে কাজে লেগে যেত।
সে খুব দ্রুত কাজ করতো। সারাবাড়ির কাজ তাকে যে একাই
শেষ করতে হবে। রাতেরবেলা মেয়েটি রান্নাঘরের বিশাল চুল্লিটার সামনে গিয়ে একা একা বসে
থাকে। কাঠ পুড়ে পুড়ে আঙ্গার হয়ে যাচ্ছে। এই আঙ্গার বা পোড়া কাঠের টুকরোকে বলে সিনডার
আঙ্গার আঙ্গার। এত কাজের মাঝে স্বপ্ন দেখে বলেই সৎবোনেরা তাকে উপহাস করে ডাকে ‘সিনডারেলা’।
তারা মেয়েটিকে একদণ্ড শান্তিতে থাকতে দেয় না। যদি
কাজ না থাকে তবে ওরা অকাজের দ্বায়িত্ব দেয় মেয়েটিকে। তারা ঘৃণা করে, অবজ্ঞা করে সিনডারেলাকে।
তারা অহংকারে বাঁকা ধনুকের মতো হয়ে উঠে। কিন্তু সিনডারেলা কখনই টুঁ শব্দটি করে না।
সিনডারেলা দিন দিন আরো সুন্দর হয়ে উঠে, তার গালে গোলাপের
আভা, নীল উজ্জ্বল তার চোখ।
সারাক্ষণ কাজের মধ্যে সে ফুরফুরে মেজাজে থাকে। আরো
তন্বী-তরুণী হয়ে উঠে সে।
নানা ঝাক্কিঝামেলার মাঝেও সিনডারেলার সমব্যথী একজন
আছে। সে হচ্ছে তার পরী-মা। এই পরী-মা থুরথুরে বুড়ি। সামনে ঝুঁকে হাঁটে সে। পিঠে তার
কুঁজ। লজঝর পোশাক তার পরনে। মাথায় থাকে ঝুরঝুরে একটা টুপি। দুই বোন; পরীকে দেখলে হাসাহাসি
শুরু করে। বুড়ি যা বলে তাতেই উপহাস করে তারা।
এইভাবে সিনডারেলার দিন কাটে। মাস গিয়ে বছর শেষ হয়। চোখের জলে, দুঃখে-কষ্টে, ভালবাসা বেদনায় বয়স বাড়ে সিনডারেলার।
পৃষ্ঠা ১/ ৭
সেবার বছর প্রায় শেষ হয়-হয়। সামনেই ছিল বড়দিনের উৎসব।
সেই বুড়ি পরী একবার বড়দিনের উৎসবে এসেছিল। ঘুমিয়ে থাকা সিনডারেলার গালে, চিবুকে, চোখে
পরী-মার একেকটি স্পর্শ যেন একেকটি উপহার! কে আর জানে! হয়তো একারণেই গোলাপের আভা খেলে
যায় সিনডারেলার গালে!
সিনডারেলা ওদের দুর্ব্যবহারে আর আহত হয় না। ওদের মারধর
আর কটুক্তিতে এখন সিনডারেলার চোখে জল আসে না। দুই বোনকে এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করে সে।
একা একা কাজ করে, গুনগুন করে গান গায়, কেউ তাকে বকা দেয় না।
সিনডারেলার বয়স যখন আঠারো তখন একদিন শহরের এ-মাথা
থেকে ও-মাথা পর্যন্ত রাজার একটা ঘোষণা ছড়িয়ে পড়ল। ঢাক-ঢোল বাজিয়ে বাদকদল ঘোষণা দিতে
লাগল, বড়দিন উপলক্ষে রাজপ্রাসাদে অভূতপূর্ব আনন্দ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। নাচ-গান,
খাওয়া-দাওয়ার এমন ফূর্তিময় অনুষ্ঠান এ রাজ্যে আগে কখনও হয়নি। পাহাড়ের চূড়ায় জ্বলবে
আগুনের ফোয়ারা। রাস্তার মোড়ে মোড়ে সাজানো হবে আলোকমালা। এই উৎসবের পরদিন দেশের একমাত্র
রাজকুমারের বয়স হবে একুশ। আর এই আনন্দ অনুষ্ঠানে রাজ্যের সকলেই আমন্ত্রিত।
বাদক দলের এই ঘোষনা শুনেই আনন্দের ঢল বয়ে গেল রাজ্যজুড়ে।
সবাই অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগল।
রাজার দূতেরা আরও ঘোষণা করলো, রাজ্যের কুমারী মেয়েরা
বিশেষভাবে আমন্ত্রিত। সিনডারেলার বড় দু’বোন এ ঘোষণা শুনে আনন্দে নাচতে
লাগল। শুধু ঘোষণা পৌঁছাল না সিনডারেলার কানে।
এই ঘোষণার পর দুইবোন প্রতিদিন নিজেদের সুন্দর করে
তোলার ব্যাপারে ব্যস্ত রইল। বারবার তারা দাঁড়ায় আয়নার সামনে।
কেন সিনডারেলার চেয়ে সুন্দর নয় এ নিয়ে দু’বোনের মধ্যে শুরু হয় ঝগড়া। কিভাবে
তাদের সুন্দর লাগবে-সিনডারেলা কেন তাদের সাহায্য করতে পারছে না এই নিয়ে সিনডারেলাকে
তারা বকাঝকা করতে লাগলো। বকা শুনে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সিনডারেলা তাদের পোশাক
গুছিয়ে দিতে থাকলো। প্রাণান্ত পরিশ্রম করে সিনডারেলা ওদের মন পেতে চাইলো। কিন্তু দুই
বোনের মন শান্ত হল না।
তারপর এল সেই আমন্ত্রিত রাতের আনন্দ-অনুষ্ঠান। আলোকমায়ায়
সজ্জিত হয়ে উঠল রাস্তাঘাট, বাড়িঘর। সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে আনন্দ আর উৎসবের আমেজ। হাসি
আর সুরের মূর্ছনায় উদ্বেলিত সেই শহর।
দুই বোনও সেজেগুজে তৈরি হল। রঙচঙ মেখে যেন কুৎসিত
চেহারা আরো কুৎসিত হল। তাদের এত আয়োজন দেখে সিনডারেলারও যেতে ইচ্ছে হলো কিন্তু মুখ
ফুটে সে কিছু বলার সাহস পায় না। ভাড়া করা একটা গাড়ি চেপে রাজপ্রাসাদের দিকে রওনা দিল
দুই বোন।
সিনডারেলা তখন ক্লান্ত, ভীষণ ক্লান্ত। তবু তার কাজে বিরাম নেই। বোনদের এলোমেলো ঘর গুছগাছ করতে হলো তার। তারপর খাবার বানিয়ে কিছুটা স্বস্তি পেল সিনডারেলা।
পৃষ্ঠা ২/ ৭
একা একা রান্নাঘরে গিয়ে চুলোর সামনে শরীরটাকে জুড়িয়ে
নেওয়ার সুযোগ পেল সে। চুলোর সামনে সে ছোট টুলে বসে বসে নিস্তব্ধতার মাঝে শুনতে পেল,
দূরে কোথাও হইচই হচ্ছে। ভাড়ি বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে গান হচ্ছে। শিশিরের শব্দ আর দূর
থেকে আসা গানের ধ্বনিতে টুলে বসেই ঝিমুতে ঝিমুতে হঠাৎ করে ঘুমিয়ে গেল দুঃখী সিনডারেলা।
চারদিকে সুনসান নিরবতা। কিন্তু হঠাৎ করেই মিষ্টি ও
মৃদু এক শব্দ কানে এলো তার। কে যেন মিষ্টি করে ধীর স্থিরভাবে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে।
টুকটুক... দরজায় টোকা দেওয়ার সেই শব্দ আচমকায় এসে ধাক্কা লাগে সিনডারেলার কানে।
ঘুম জড়ানো চোখে জেগে উঠে সিনডারেলা। এই অন্ধকারে তুষারপাতের
মধ্যে কে এলো বাড়িতে? সিনডারেলা টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বাতি জ্বালিয়ে সিড়ি বেয়ে নেমে
এসে খিল খুলে মেয়েটি বাইরে তাকালো। দেখলো দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে এক বুড়ি। তার কাঁধ
থেকে ছড়িয়ে পড়েছে বকলেস-বাঁধা সবুজ রঙের ঢলঢলে এক পোশাক। পোশাকটা নেমে গেছে একদম পা
পর্যন্ত।
ওগো মেয়ে, শুভ রাত্রি জানাই তোমাকে।
বুড়িমা মিষ্টি করে বলল, তুমি জানোনা আমি কে! তুমি
একা একা রান্নাঘরে বসে আছো কেন? পৃথিবীর সবাই এখন রাজপ্রাসাদে আনন্দ-অনুষ্ঠানে যোগ
দিতে গেছে। সিনডারেলা এবার মন দিয়ে বুড়ির দিকে তাকালো। বুড়ির আগমনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
করলো সিনডারেলা। তারপর সারাদিনের ঘটনাটা বর্ণনা করলো বুড়ির কাছে। সবশুনে যেন আর্তনাদ
করে উঠল বুড়ি।
আহা, আহা!!! শোন ছোট্টমেয়ে, আমি বলছি, এখন তোমাকে
যেতেই হবে। এসো, কাছে এসো। আর দেরি নয়। রাত দ্রুত ফুরিয়ে যাবে। তুমি তৈরি হয়ে নাও।
চলো, শিগগির চলো রাজপ্রাসাদে।
মুখে করুণ হাসি ফুটিয়ে সিনডারেলা পরিকে জানায় তোমার
আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ, মা। আমার খুব ইচ্ছে করছে অনুষ্ঠানে যেতে। কিন্তু আমি দুঃখীত।
আমি যে একেবারেই প্রস্তুত নই।
বুড়িমা লাঠিতে ঠুকঠুক করে ভর দিয়ে সিনডারেলার হাত
পা চেপে ধরল।
আহা দুঃখী মেয়ে! তোমার দেখি ছেঁড়া পোশাক। ঠিক আছে,
এটা কোন সমস্যা নয়। তোমার পোশাকের ব্যবস্থা আমি করছি।
বুড়িমা তার ছোট্ট লাঠিটা বাতাসে দু’পাক ঘোরালো। একটা চৌকোনা চামড়ার
বাক্স সামনে ভেসে উঠল। বাক্সটি সোনার শেকল দিয়ে বাঁধা, রুপোর তালা ঝুলছে বাক্সের মুখে।
বুড়িমা তার ছোট্ট লাঠিটা দিয়ে স্পর্শ করলো তালায়।
ঝট করে খুলে গেল বাক্সটা। বাক্সের ভেতর রয়েছে অপূর্ব দামি একটা পোশাক। সিল্কের পোশাকটিতে
সোনা রুপার কাজ করা। বিস্ময়কর সব জিনিস দিয়ে সাজানো হয়েছে পোশাকটি।
পরী বলল, এই নাও তোমার পোশাক। হাতমুখ ধুয়ে নিয়ে পোশাকটি
পরে ফেল। খুব তাড়াতাড়ি আমরা রওয়ানা দেব।
সিনডারেলা একদৌড়ে খুব ভালো করে মুখহাত ধুয়ে এলো। গোলাপ ফুলের মতো ললাভ হয়ে উঠল তার গাল।
পৃষ্ঠা ৩/ ৭
হাতগুলো হয়ে উঠল ফুলের মতোই সজীব ও উজ্জ্বল। পুরনো
ভাঙ্গা চিরুনি দিয়ে মাথাটা বারকয়েক আঁচড়ে নিল সে। নতুন পোশাক পড়লো সিনডারেলা। পরী-বুড়ি
যত্ন করে বেঁধে দিল সেই পোশাকের ফিতে। ঘনকালো চুলে বেঁধে দিল সবুজপাতা ও শুভ্র তুষার
ফুল। এখন তারা প্রস্তুত। যাবে রাজপ্রাসাদে।
কিন্তু সিনডারেলা চিন্তিত হয়ে পড়ল। বলল, কিন্তু মা,
আমার যে জুতো নেই। ধুলোজমা ময়লা একপাটি জুতো আছে আমার। এখন কি হবে?
বুড়িমা জুতোজোড়া দেখে ফিক করে হেসে ফেলে। সত্যি সত্যিই
এমন পুরনো মলিন জুতো হয়তো পৃথিবীর আর কোথাও নেই।
বুড়িমা বলল- কোন চিন্তা নেই মামণি, কোন অসুবিধা নেই।
এই ধুলোজমা ছেঁড়া জুতোই দ্যাখো কেমন নতুন হয়ে যায়।
হাতের লাঠিটা নিয়ে বুড়িমা জুতোর উপর কয়েকবার পরশ বুলালো।
অমনি বাতাসে ভেসে এলো একজোড়া নতুন চকচকে জুতো। সিনডারেলা স্বপ্নেও এমন সুন্দর জুতো
দেখেনি। যেন একটুকরো কাচের তৈরি- এমনই উজ্জ্বল, এমনই চকচকে।
দুই পায়ের দশ আঙ্গুল আলগোছে জুতোর ভেতরে ঢুকিয়ে দিল
সিনডারেলা। জুতোটি পায়ে এমনভাবে এটে গেল যেন জুতোটি তৈরি করা হয়েছে সিনডারেলার পায়ের
জন্যই।
‘ওগো পরী মা, দ্যাখো আমাকে কি সুন্দর
লাগছে জুতোটায়। এখন আমি সম্পূর্ণ তৈরি।’ চিৎকার করে আনন্দ প্রকাশ করলো
সিনডারেলা। বারবার গ্রাউনের নিচটা তুলে ধরে চকচকে অপূর্ব জুতোটার দিকে তাকাল সে। মেয়েটির
আনন্দে বুড়িমার খুশি যেন আর ধরে না।
তারপর বুড়িমা বলল, ‘এখন আমরা যাব কিভাবে? এই তীব্র
ঠাণ্ডা আর তুষারের মধ্যদিয়ে যাওয়ার উপায় কি?’ চিন্তিত হয়ে ওঠে পরী-মা।
‘মা! হাঁটতে আমার একদমই কষ্ট হয়
না। চলো আমরা হেঁটেই চলে যাই।’ সিনডারেলা আশ্বস্ত করতে চায় বুড়িমাকে।
বুড়িমা কিছু না বলে তার লাঠিটা আবার হাতে নেয়। বুড়িমা
লাঠিটা তুলে একটা চালকুমড়োর দিকে ইঙ্গিত করে। রান্নাঘরের পাশে রয়েছে কুমড়োটা।
বুড়িমা কিছু না বলে তার লাঠিটা বুলাতে থাকে কুমড়োটার
উপর। কুমড়োটা ধীরে ধীরে ফ্যাকাশে হতে থাকে। অবাক বিস্ময়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে সিনডারেলা।
কুমড়োটা নরম হয়ে ভেঙে যেতে থাকে। তারপর সেই কুমড়োর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে অসাধারণ সুন্দর
এক গাড়ি। রূপার হাতল আর সোনার আসন তার। মখমলের ঝালর ঝুলছে চারপাশে।
গভীর প্রশান্তির নিশ্বাস ফেলে পরী। এমন সময় গর্ত থেকে
ছুটে এলো বারোটা ইঁদুরছানা।
লাঠিটাকে ইঁদুরছানাদের ওপর ঘুরিয়ে দিতেই অদ্ভুত এক কাণ্ড ঘটলো। বারোটি হরিণে রূপান্তরিত হলো তারা। হরিণগুলো যেমন তাগড়া তেমনই তাদের খাড়া-খাড়া শিং। রুপোর নাল লাগানো পায়ে। শিং এ মোড়ানো রুপোর পাত।
পৃষ্ঠা ৪/ ৭
ছয়টি হরিণ দাঁড়িয়ে আছে খোলা আকাশের নিচে, দুটো হরিণ
সদর দরজায় আর চারটা হরিণ গাড়ির সাথে।
এরপর বুড়িমা আবার লাঠি ঘুরালো। চারটে কালো ইঁদুর রূপান্তরিত
হলো চারজন মানুষে। একজন গাড়ির কোচম্যান। দুইজন থাকলো গাড়ির সামনে আর পিছনে। একজন প্রহরী-
সে দাঁড়িয়ে রইল গাড়ির দরজা ধরে। লাগাম ধরে কোচম্যান অপেক্ষা করতে লাগল-কখন সিনডারেলার
আগমন ঘটবে?
তখন বুড়িমা বলল, শোনো সোনামণি, এখন সব প্রস্তুত। তুমি
যেতে পার। কিন্তু একটা কথা, মধ্যরাতের সময় অবশ্যই তোমাকে ফিরতে হবে। রাত বারোটা বাজার
সাথে সাথে তুমি এসে চাপবে গাড়িতে। কথাটা যেন অবশ্যই মনে থাকে তোমার।
সিনডারেলা গভীর মমতা নিয়ে তাকালো বুড়িমার দিকে। কাঁদো-কাঁদো
স্বরে কথা বলল- ‘মা, ওগো মা, কিভাবে যে আমি তোমাকে ধন্যবাদ জানাই।’
‘ঠিক আছে মা। তোমার উজ্জ্বল চোখই
বলে দিচ্ছে, তুমি কতটা ভালোবাসো আমাকে’- বলেই পরীমা আলতোভাবে চুমু খেল
সিনডারেলাকে। তারপরই গাড়িটার ছুটে চলা শুরু হলো। শব্দহীনভাবে, বাতাসের চেয়েও দ্রুত,
নরম উলের মতো হালকাভাবে।
ছুট! ছুট! ছুট!
রাস্তায় তখনও জ্বলছে অগ্নিশিখা। উঁচু উঁচু বাড়িঘরের
জানালা বা বারান্দায় জ্বলছে বড় বড় মোমবাতি। অতিথি অভ্যাগতদের আগমন প্রায় শেষ হয়ে গেছে।
এরই মধ্যে দিয়ে সিনডারেলার গাড়ি ছুটে চলেছে।
প্রসাদের সামনে লোকজনের ভিড়। সিনডারেলার অপূর্ব গাড়ি
দেখে সবাই উৎসুক। অবাক বিস্ময়ে তারা দেখছে সিনডারেলাকে। সবাই হর্ষধ্বনি করতে লাগলো
তাকে দেখে। কিন্তু সিনডারেলার কানে এসব কিছুই প্রবেশ করছে না। বাতাসের বেগে ছুটে চলেছে
তার গাড়ি।
সিনডারেলা এক সময় প্রবেশ করলো আনন্দ-অনুষ্ঠানের সভামঞ্চে।
আনন্দের বাহার সেই হলরুমে। সিনডারেলাকে দেখেই রাজকুমার তার আসন থেকে নেমে এলো। সোনার
আসনে বসে আছেন রাজা আর রানি। রাজকুমার সিনডারেলার রূপে মুগ্ধ হয়ে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে
রইলো। তারপর সিনডারেলাকে নিয়ে গেল মঞ্চের কাছে। তার হাত ধরে নাচতে লাগলো।
হর্ষ ও আনন্দধ্বনির মধ্যে নৃত্যের তালে তালে স্বর্গীয়
সুখের রাজ্যে যেন ভেসে বেড়াচ্ছে সিনডারেলা। এখানে কোনো অবজ্ঞা নেই। আসরে উপস্থিত সবাই
সিনডারেলার রূপে মুগ্ধ। কে এই রাজকুমারী?
শুধু তাকে দেখেনি তার দুই সৎবোন। তারা বসে আছে আসর
থেকে কিছুটা দূরে। তারা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না, আসরের মধ্যমণি এখন কে? দূর থেকে একবার
দেখে সিনডারেলাকে তারা চিনতেও পারেনি। ওকে এখানে কল্পনাও করতে পারে না সৎবোনেরা।
এদিকে রাজকুমারের সঙ্গে নেচেই চলেছে সিনডারেলা। ঠিক
এমন সময় সিনডারেলার কানে ঘন্টাধ্বনির মৃদুমধুর শব্দ এসে আঘাত হানে। রাজপ্রাসাদের বড়
ঘড়িতে তখন ঘন্টা পিটছে-এক, দুই, তিন...
এ ঘড়ির শব্দ শুনেই কাঁপন শুরু হলো সিনডারেলার। মনে পড়ল পরীমার কথা।
পৃষ্ঠা ৫/ ৭
এখন ঘড়িতে কয়টা বাজে? জানতে চাইলো সিনডারেলা। রাজকুমার
বলল, এখন মাত্র মধ্যরাত।
কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ফ্যাকাশে হয়ে গেল সিনডারেলার
চোখমুখ। মূহুর্তের মধ্যে রাজকুমারের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিল নিজের হাত।
ঘড়িতে তখন বাজছে- পাঁচ, ছয়, সাত।
খুব দ্রুত দৌড় শুরু করলো সিনডারেলা। হলরুম থেকে বেড়িয়ে
একদৌড়ে সে এলো লম্বা করিডোরে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে বামপায়ের জুতোটা খুলে গেল। সেদিকে
ভ্রূক্ষেপ করলো না সিনডারেলা। ঘড়িতে তখন এগারোবার ঘন্টা বেজে গেছে। দমবন্ধ অবস্থায়
একছুটে গিয়ে সে চেপে বসল গাড়িতে। তখন শব্দে ঘড়িতে বারোটা বাজল। ঠিক বারোটায় তার গাড়িতে
চাপার কথা।
তারপর মূহুর্তের মধ্যে কি ঘটলো কিছুই মনে নেই সিনডারেলার।
খানিকবাদে সে টের পেল, ঠান্ডা কালো রান্নাঘরের বারান্দায় সে একাকি দাঁড়িয়ে আছে। যেন
কিছুই ঘটেনি, কোথাও কোনো পরিবর্তন হয়নি। চুল্লিতে আগুন জ্বলছে, মোমবাতিতে মৃদু আলোর
উদ্ভাস। মোটা কুমড়োটা পড়ে আছে রান্নাঘরে।
পরনে এখন তার ছেঁড়া পোশাক। চুলোর পাশে বসে উত্তাপ
নিতে লাগলো বেচারি। এখনও তার চোখেমুখে দু-একটি তুষারবিন্দু লেগে আছে। এতেই প্রমাণ হয়
সে বাইরে গিয়েছিল।
সব ঘটনা যেন ঘটে গেল স্বপ্নের মতো। কিন্তু স্বপ্ন
নয়-সিনডারেলা জানে, যা যা ঘটেছে সবই সত্যি।
একটু পরেই সে টের পেল, তার একপায়ে জুতো অন্য পায়ে
জুতো নেই। সেই চকচকে, কাচের মতো স্বচ্ছ জুতো। বাম পায়ে রয়েছে কালো মোজা, এসবই ছিল পরী-মার
জাদু! সব মিলিয়ে গেছে। কিন্তু ডান পায়ের জুতোটা এখনও রয়ে গেছে। কিন্তু জুতোটা এখন কোথায়
লুকিয়ে রাখা যায়, কি করা যায় একপাটি জুতো নিয়ে এইসব সাতপাঁচ ভাবছে।
এমন সময় উচ্চশব্দে দরজা ধাক্কা দেয়ার শব্দ কানে এলো
তার। সে বুঝতে পারলো, সৎবোনেরা আনন্দ অনুষ্ঠান থেকে ফিরে এসেছে। এক পায়ে জুতো, এক পা
খালি- এই অবস্থাতেই তাড়াহুড়ো করে উপরতলায় চলল সিনডারেলা। হাতে তার স্যুপের বাটি। সৎবোনেরা
ঘুমের আগে স্যুপ খাবে। কথামতো কাজ না হলে বোনেরা রাগারাগি করবে। ওদের পোশাক-আশাক গুছিয়ে
রাখলো সিনডারেলা। জুতোজোড়া একটু দূরে রাখাতে ওরা বকা শুরু করলো। সিনডারেলার সব কাজেই
ওদের দোষ ধরা চাই।
দুই বোন অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে নিজেদের মধ্যে। বিষয় একটাই যে, রাজপ্রাসাদের উৎসবে আজ দারুণ আনন্দ হয়েছে। এক অদ্ভুত রাজকন্যার আবির্ভাব হয়েছিল অনুষ্ঠানে। সবার শেষে সে প্রবেশ করে। রাজকুমার তার রূপে মুগ্ধ হয়। শুধু রাজকুমার নয়, রাজা-রানিসহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাই ধন্য-ধন্য করেছে তাকে দেখে। কিন্তু সৎ দুই বোনই শুধুমাত্র তাকে দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেনি। তারপর হঠাৎ করেই সে চলে গেছে।
পৃষ্ঠা ৬/ ৭
বোনদের কথাগুলো দাঁড়িয়ে থেকে শুনে তাদের চোখের দিকে
তাকিয়ে কৌতুক বোধ হয় সিনডারেলার। একটাই মাত্র প্রশ্ন করে সে, রাজকন্যা চলে গেল! আর
ফিরবে না? কিন্তু বোনেরা তার কথায় কোন কর্ণপাত করলো না। নিজেদের আলাপেই তারা ব্যস্ত।
কাজ শেষে সিনডারেলা নেমে এলো নিচে। তার সৌভাগ্য, কথা
বলার সময় বোনেরা তার দিকে তাকায়নি। পায়ের দিকে তো নয়ই।
অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতো রান্নাঘরে এসে পরম তৃপ্তিতে
আজ সিনডারেলা ঘুমিয়ে পড়লো।
পরদিন খুব সকালে আবার রাস্তায় নেমে এলো বাদকের দল।
আবার তারা নতুন এক ঘোষণা শুরু করলো, ‘গতরাতের অনুষ্ঠানে একটি মেয়ে বলনাচে
অংশগ্রহন করেছিল। মেয়েটি ছুটে চলে যাওয়ার সময় রাজকুমার সেই আগন্তুক কুমারীর একপাটি
জুতো উদ্ধার করতে পেরেছে। এখন রাজকুমার সেই আগন্তুক সুন্দরীর সন্ধান চায়।’
বাদক দলেরা ঘোষণা দিল- যে ব্যক্তি আগন্তুক সুন্দরীর
সন্ধান দিতে পারবে তার জন্য রয়েছে বিপুল পুরষ্কার। কেউ যদি আরেক পাটি জুতোরও সন্ধ্যান
দিতে পারে তাকেও দেয়া হবে পুরষ্কার হিসেবে বিপুল ধনসম্পদ।
কিন্তু পুরষ্কারের লোভেও কেউ কোনো তথ্য দিতে পারলো
না রাজকুমারকে। তারপর রাজা ডাকলেন তার সভাসদস্যদের। একজন বুদ্ধি দিল-একপাটি জুতো নিয়ে
বেরিয়ে পড়া হোক এই রাজ্যে। প্রতিটি তরুণীর পায়ে এই জুতো পরানো হবে। যার পায়ে ঠিকমতো
জুতোটা লাগবে তাকেই নিয়ে আসা হবে সেদিনের আগন্তুক সুন্দরী হিসেবে। তৎক্ষণাৎ রাজদূতেরা
বেরিয়ে পড়লো।
সেই চকচকে, স্বচ্ছ, মুক্তোর মতো জুতোটা নিয়ে রাজদূতেরা
ঘুরে বেড়াতে লাগলো প্রতিটি বাড়িতে বাড়িতে। প্রত্যেক তরুণীকে জুতোটা পরাবার চেষ্টা করতে
লাগলো।
রাজা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ- যে করেই হোক সেদিনের সুন্দরীকে
খুঁজে বের করতেই হবে। কিন্তু কারো পায়েই লাগে না সেই জুতো। কারো কারো পায়ে জুতোটা অতি
ছোট হয়ে যাচ্ছে। যাও বা কষ্টমষ্ট করে পা ঢোকে কিন্তু আঙুলগুলো খাপে খাপে বসে না।
এদিকে রাজপ্রহরীদের বিরাম নেই। জুতোর প্রকৃত মালিককে
খুঁজে বের করতেই হবে।
শেষমেশ রাজদূতেরা এসে পৌছল পুরনো পাথরের বাড়িতে যেখানে
একসাথে থাকে তিন বোন। ইতোমধ্যে সৎ দুইবোন রাজপ্রহরীদের আগমনের কারণ জেনে গেছে। কিন্তু
বিভিন্ন কৌশল করেও দুবোন জুতায় পা ঢোকাতে পারলো না।
এমন সময় একজন দূত বলল, এই বাড়িতে আর কেউ কি আছে? দুইবোন
তখন ভীত হয়ে এ-ওর দিকে তাকালো। তারপর মিথ্যা করে বলল, না। আর কেউ নেই।
ঠিক সেই সময়- কোথা থেকে যেন মিষ্টি সুরেলা এক কন্ঠস্বর ভেসে এলো। দূত প্রশ্ন করলো, এই অপূর্ব কন্ঠস্বর ভেসে আসছে কোত্থেকে? দুই বোন আড়চোখে নিজেদের দিকে তাকালো। তারা বলল, ‘হয়ত, আমাদের খাচাঁয় বন্দি শুকপাখির কন্ঠস্বর আপনারা শুনতে পেয়েছেন। অথবা কল থেকে পানি পড়ার মধুর শব্দ শুনে ভাবছেন- ভেতরে কেউ আছে।’
পৃষ্ঠা ৭/ ৭
রাজদূত তখন রাগে ফেটে পড়ে বলল, ‘পানির কল কি গান গাইতে পারে?’
দুজন দূতকে ভেতরে পাঠানো হলো। কে গান গায়? তাকে ধরে
নিয়ে এসো। রান্নাঘর থেকে সিনডারেলাকে তারা রাজদূতের সামনে নিয়ে এলো। সিনডারেলার পরনে
সেই ছেঁড়া পোশাক, হাতে কালিঝুলি লেগে আছে। রাজদূতের সামনে এনে তাকে দাঁড় করানো হলো।
কিন্তু একপাটি চকচকে জুতো দেখেই হাসি পেল সিনডারেলার।
মিটমিট করে হাসতে লাগলো সে। রাজদূতেরা প্রশ্ন করল, তুমি মিটিমিটি হাসছো কেন?
সিনডারেলা জানালো, অবিকল একই রকম দেখতে আমারও একপাটি
জুতো আছে। আমার ডানপায়ের জুতো।
‘কোথায়? কোথায় সেই জুতো?’ উদগ্রীব হয়ে উঠলো রাজদূত।
সিনডারেলা- ‘রান্নাঘরে।’
একজন দূত ছুটে গিয়ে জুতোটা নিয়ে এলো। আরে কি আশ্চর্য!
সিনডারেলার পায়ে জুতোজোড়া মাপমতো লেগে গেল। তার পায়ের গোড়ালি আর দশ আঙুল এমনভাবে জুতোর
ভেতরে লেপ্টে রইলো যেন এই জুতো তৈরি হয়েছে সিনডারেলার জন্যই। তাকে খুব দ্রুত রাজা-রানির
সামনে উপস্থিত করা হলো।
সিনডারেলাকে দেখে রাজা-রানির খুশি-আনন্দ আর ধরে না।
যেন তারা তাদের হারানো মেয়েকে খুঁজে পেয়েছেন।
তারপর শুরু হলো রাজকুমারের সঙ্গে সিনডারেলার বিয়ের
উৎসব। দূর থেকে পরীমা আবার সিনডারেলাকে দোয়া করলো।
ওদিকে সৎ দুইবোন ঘরে বসে বসে রাগে দুঃখে হিংসায় জ্বলেপুড়ে মরতে লাগলো। আর রাজকুমারের সঙ্গে সুখে-শান্তিতে দিন কাটতে লাগলো সিনডারেলার। দুঃখের আগুনে পুড়তে থাকা সিনডারেলার সামনের দিনগুলো খাঁটি সোনায় উদ্ভাসিত হলো।
***** সমাপ্ত *****
পূর্বের পোষ্ট: হ্যামিলনের সেই বাঁশিওয়ালা (জার্মান লোককাহিনী) || লোককাহিনী - ১৮
পরবর্তী পোষ্ট:
‘লোককাহিনী’ ক্যাটাগরির জনপ্রিয় গল্পসমূহ
◉ একটা ব্যাঙের গল্প (তিব্বতের লোককাহিনী)
◉ মানসিক আঘাতের বেদনা (তাজাকিস্তানের লোককাহিনী)
◉ হলদে ঝুঁটির মোরগটি (রাশিয়ার লোককাহিনী)
◉ এক যে ছিল শেয়ালনী (ইউক্রেনের লোককাহিনী)
◉ ইয়ারার গল্প (ব্রাজিলের লোককাহিনী)