হাতির চেয়ে চড়ুই কেন শক্তিশালী (আফ্রিকার লোককাহিনী) || লোককাহিনী - ১২

 

সারমর্ম: ছোট্ট এক চড়ুই পাখি যেভাবে তার বুদ্ধির জোড়ে বনের দুই মহাশক্তিশালী প্রাণীকে পরাজিত করলো। মোট-৩ পৃষ্ঠা


আফ্রিকা মহাদেশের কথা তো আমরা কতোবার, কতো জায়গায়-ই না শুনেছি। কোথাও কোন বনজঙ্গল চোখে পড়লেই আমরা অনেকে আফ্রিকান জঙ্গলের প্রসঙ্গ টেনে আনি। আফ্রিকান সেই জঙ্গলের একটি কাহিনী শুনবো এবার।

আফ্রিকার গভীর বন-জঙ্গলের কথা আমরা তো সবাই জানি। সে এক গহীন জঙ্গলের কাহিনী। সেখানে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো পৌঁছায় না মাটিতে। চারপাশে পাতা ঝরার শব্দ ছাড়া আর কিছু নেই। নীরব সেই বন।

বনের মাঝখানে বিশাল একটা তেঁতুল গাছ। সেই তেঁতুল গাছের ডালে থাকে ছোট্ট একটা বাদামি রঙের চড়ুই পাখি। ছোট্ট এত্তোটুকুন তার বাসা। বাসায় তার অনেকগুলো ডিম। চড়ুই পাখি মনের আনন্দে সেই ডিমে তা দেয়।

বনের পরিবেশ সবসময়ই চুপচাপ। কোন হইচই নেই, মারামারি নেই। গভীর নীরবতায় ঢেকে থাকে বনভূমি।

একদিন ডিমে তা দিচ্ছে চড়ুই। হাতির ধাক্কায় হঠাৎ করেই গাছটা নড়েচড়ে উঠল থরথর করে। সেই সাথে ভয়ংকরভাবে দুলতে থাকলো চড়ুইয়ের ছোট্ট বাসাটাও। এটা দেখে চড়ুই তো রেগে আগুন। মাথামোটা হাতির কান্ড দেখ!

চিঁ চিঁ করে চিৎকার করে চড়ুই বলতে লাগল, শোন ওহে হাতি, কোন আক্কেলে তুমি এমন কাজ করলে? এমন জোরে গাছে ধাক্কা দিলে যে আমার ডিম ফেটে নষ্ট হয়ে যাবে! তোমার এই পাগলামি একদম সহ্য করব না কিন্তু।

চড়ুইয়ের কথা শুনে হা হা করে হাসতে লাগল হাতি। সে বলল, আমি আবার গাছটা নাড়ালাম কই? আর গাছটা যে নড়েছে এটা বোধহয় তুমি ছাড়া আর কেউ জানেও না।

চড়ুই তখন রাগে কাঁপছে। সে বলল- শোন হাতি, তুমি আবার যদি গাছে ধাক্কা দাও তাহলে আমি তোমাকে দেখে নেব।

হাতিটা প্রাণ খুলে হাসতে লাগল।

বোকার মতো হেসো না। আবার যদি ধাক্কা দাও তবে তোমায় এমনভাবে বেঁধে ফেলব যে তুমি আর নড়তেই পারবে না। - রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললো চড়ুই।

চড়ুইয়ের কান্ড দেখে হাতিটা হাসতে হাসতে চলে গেল।

চড়ুইটা আবার আপন মনে ডিমে তা দিতে বসলো। নিস্তব্ধ হয়ে গেল বনভূমি। হঠাৎ চড়ুইটার পানির তেষ্টা পেল। ডিমগুলো ছেড়ে ফুরুৎ করে চড়ুইটা উড়ে গেল কাছের একটা নদীতে। নদীর তীরে ঘাসে-ঢাকা খানিকটা জায়গা আছে। সেখানে টলটল করে স্বচ্ছ পানি। চড়ুই মাঝে মাঝেই এখানে আসে পানি খেতে।

আজও পানি খেতে এসে চড়ুই দেখলো- একটা বড় জলহস্তি টানটান হয়ে শুয়ে আছে সেই জলায়। চড়ুই জলহস্তিকে দেখেই চমকে উঠল, আর বলল, ওহে জলহস্তি, এখানে এসে এক চুমুক টলটলে পানি খাই, তাও সহ্য হয়না তোমার। কেমন চিৎ হয়ে শুয়ে আছ। পানিও ঘোলা হয়ে গেছে। এত বড় নদীতে আমি পানি খেতে যাব কী করে?


পৃষ্ঠা ১/ ৩



জলহস্তি বলল, এ নদী কারও একার নয়। এই জায়গায় তোমার নাম লেখা আছে নাকি?

চড়ুই বলল, কথা বাড়িও না জলহস্তি। ভালো হবে না বলে দিচ্ছি। আবার যদি দেখি তুমি এই জায়গায় এসেছ তবে তোমাকে এমনভাবে বাঁধব যে নড়াচড়া করার শক্তিটুকু থাকবে না তোমার।

চড়ুইয়ের কথা শুনে জলহস্তি হেসে উঠল আরো জোরে। বলে কি পুঁচকে চড়ুই? ঠিক আছে, পারলে বেঁধো আমায়, তুমি আমায় কি করে বাঁধবে তা আমি দেখতে চাই। এটা বলেই জলহস্তি আবার হাই তুলে জলাভূমিতে শুয়ে পড়ল। সে এখন রোদ পোহাবে।

চড়ুই বেচারা কি আর করে? ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল নদীর আরেক ধারে। সেখানে দেখতে পেল একটা গর্তে কিছু কাদামাখা ঘোলা পানি। সেই পানিই চুকচুক করে পান করল চড়ুইটা। তারপর তার বাসায় ফিরে গিয়ে আবার ডিমে তা দিতে বসল।

পরদিন খুব সকালেই হাতিটি গাছতলায় এসে হাজির। শুঁড়টা দুএকবার নড়াচড়া করে বিকট জোঁরে হাঁক দিল সে।

কই হে চড়ুইছানা, কোথায় তুমি? একটা বলেই শুঁড় দিয়ে সজোরে একটা ধাক্কা দিল গাছে। গাছটা নড়েচড়ে উঠল। আর তাতেই দুলে উঠল চড়ুইয়ের বাসাটাও।

চড়ুই রাগে তিরমির করে কাঁপতে লাগল, আর বললো- দাঁড়াও তোমাকে মজা দেখাচ্ছি।

হাতি- আরে আমি তো মজা দেখার জন্যই এসেছি। আমিও তো সেটাই চাই। একটা পিচ্চি চড়ুই হাতির থেকে শক্তিশালী একথা কে, কবে, কোথায় শুনেছে!

একটু সবুর কর। টের পাবে তারপর। এই বলে চড়ুইটা ফরফর করে উড়ে গেল পাশের একটা গাছে। সেই গাছে একটা লম্বা শক্ত লতা গজিয়ে উঠেছিল। সেই লতার একটা প্রান্ত মুখে ধরে নিজের গাছে ফিরে এলো চড়ুইটা। তারপর লতাটা মুখে নিয়ে হাতির গলায় পেঁচিয়ে দিলো।

চড়ুইয়ের কাণ্ড দেখে হাতি হাসতে হাসতে আকুল হয়ে গেল। চড়ুই বলল, দাঁড়াও আমি নদী থেকে একপলকের জন্য একটু পানি খেয়ে আসছি। তুমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো। আমি এসে তোমাকে টানতে বলব। তখন দেখব তোমার গায়ে শক্তি কেমন।

চড়ুই উড়ে গেল সেই জলার ধারে। যে গাছ থেকে লতার একটা প্রান্ত এনেছিল সেই গাছে গিয়ে লতার আরেকটা প্রান্ত মুখে নিয়ে নদীর ধারে চলে গেল পাখিটা। গিয়ে দেখে, আগের দিনের মতোই জলহস্তিটা সেখানে শুয়ে পানি ঘোলা করছে।

চড়ুইকে দেখে জলহস্তি বলল, কি হে চড়ুই, যাও যাও শিগগির কেটে পড় এখান থেকে। তুমি আমার কি করবে সে আমার জানা আছে।

চড়ুইটা তখন সেই লতার আরেকটা দিক দিয়ে কুমিরের শরীরটা শক্ত করে বেঁধে দিল। তারপর বলল, একটু অপেক্ষা কর। আমি দড়িটাকে ভালো করে ধরি। আমি বললে তবে টানতে শুরু করবে।


পৃষ্ঠা ২/ ৩



একই লতার দুদিকে দুজনকে বাঁধা হল। একদিকে হাতি আর একদিকে জলহস্তি। চড়ুই উড়ে উড়ে লতাটার মাঝখানে ঘুরতে লাগল, আর চিৎকার করে বলতে লাগল, এবার টান মারো। জোরসে টান মার।

হাতি আর কুমির তখন হাসতে হাসতে টানাটানি শুরু করলো। কিন্তু তারা কেউ কাউকে দেখতে পেল না। কুমিরটা পানিতে নামার জন্য টানতে লাগল পিছন দিকে। আর হাতিটা গাছতলা থেকে বনের দিকে যাবার জন্য টানতে লাগল সামনের দিকে।

কিন্তু দুজনের গায়েই বেশ শক্তি। কেউ কাউকে নাড়তে পারছে না। চড়ুই তখন চিৎকার করে বলতে লাগল- টানো, আরো জোরে টানো। এই নাকি তোমার শক্তি।

হাতি বলল- গায়ের সর্বশক্তি দিয়েই তো টানছি। কিন্তু নাড়াতে পারছি না। ব্যাপার কি? তোমার গায়ে যে এত শক্তি সেটা জানতাম না ভাই।

জলহস্তি বলল- আর তো পারছি না। তোমার গায়ে এতো শক্তি এলো কোথা থেকে? তুমি কি জাদু জানো নাকি হে চড়ুই পাখি?

লতা টানাটানি করতে গিয়ে জলহস্তির পা পিছলে যাচ্ছিল বারবার। হাতিও দুএকবার পিছলে পড়ে পড়ে যাবার অবস্থা। সারা সকাল ধরে জলহস্তি আর হাতি দুজনে দড়ির দুদিক থেকে টানতে লাগল। কিন্তু কেউ কাউকে নড়াতে পারলো না। কারণ তাদের দুজনের শক্তি প্রায় একই সমান। অথচ দুজনেই মনে করেছিল, চড়ুই বুঝি তাদের অন্যদিক থেকে টানছে। হাতি আর জলহস্তির প্রাণান্ত লতা টানাটানি দেখে চড়ুই পাখিটা হাসতে লাগল।

কি হে! একটা পাতলা লতার বাঁধন টেনেই ছিড়তে পারছো না। আবার তোমরা কিনা শক্তির বড়াই কর। টান দাও, জোরসে টান দাও।

কিন্তু হাতি আর জলহস্তি তখন প্রায় ঝিমিয়ে পড়েছে। মুখে তাদের কোন কথা সারছে না।

জলহস্তি তখন হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, চড়ুই ভাই! আমি আগে কখনো ভাবিনী যে তুমি আমার চেয়েও শক্তিশালী। কথা দিলাম আর কখনো পানি ঘোলা করবো না। দয়া করে বাঁধনটা এবার খুলে দাও না।

হাতি বেচারাও হাঁপাতে হাঁপাতে লজ্জায় মাথা নিচু করে চড়ুই- এর কাছে ক্ষমা চাইল। চড়ুই হাতি ও জলহস্তিকে ক্ষমা করে দিয়ে মহত্ত্বের পরিচয় দিল।

ছাড়া পেয়ে জলহস্তি পানির তলে ডুব দিয়ে চলে গেল আর হাতি চলে গেল বনের গভীরে।

কিছুদিন পর চড়ুইয়ের ডিম ফুটে চারটা ফুটফুটে বাচ্চা বেরিয়ে এলো। চড়ুই নিশ্চিন্ত মনে তার বাসায় বাস করতে থাকল।

            

***** সমাপ্ত *****
 

পূর্বের পোষ্ট: ইনকাভূমির রাজপুত্র (পেরুর লোককাহিনী) || লোককাহিনী - ১১

পরের পোষ্ট: চামড়ার ব্যাগে গল্পের আত্মা (কোরিয়ান লোককাহিনী) || লোককাহিনী - ১৩
 

লোককাহিনী’ ক্যাটাগরির জনপ্রিয় গল্পসমূহ

  ◉ সাত ভাই চম্পা (বাংলাদেশী রূপকথার গল্প)

  ◉ ভাগ্যবানের ভাগ্য (ভারতের লোককাহিনী)

  ◉ গোন ও কোমার বন্ধুত্ব (জাপানের লোককহিনী)    

  ◉ চুলার উপর টাকা (আফগানিস্তানের লোককাহিনী)

  ◉ সাত বোন (চীনের লোককাহিনী)


➽ সর্বশেষ আপলোডকৃত পোষ্টসমূহ

➽ Golpo24.com

إرسال تعليق (0)
أحدث أقدم