বাংলাদেশের যে স্থানে পালা হয় শত শত বিষধর সাপ || জানা-অজানা ৪

 

সারমর্ম: বাংলাদেশে সাপের একমাত্র প্রতিপালনকেন্দ্র, যেখানে পালা হয় শত শত বিষধর সাপ? এই সাপগুলোর প্রতিমাসে খাবার খরচ কত আর কি উদ্দেশ্যেই বা এতগুলো সাপ পালা হয় এখানে, জেনে নিন বিস্তারিত। মোট-৩ পৃষ্ঠা


বাক্সবন্দী শত শত বিষধর সাপ। কেউটে, গোখরা, কিং কোবরা, রাসেলস ভাইপার, পিট ভাইপারের মত মারাত্মক বিষধর সাপগুলোকে আদর যত্ন করে লালন পালনও করা হচ্ছে চট্টগ্রামে দেশের একমাত্র ভেনম রিসার্স সেন্টারে। সেখানে সাপের বিষ সংগ্রহ ও গবেষণা করে তা থেকে সাপের বিষনাশক বা এন্টিভেনম ঔষুধ তৈরি করা হয়।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের পেছনে পুরোনো একতলা ভবন। দেখলে বোঝাই যাবে না এর ভেতরে রয়েছে শত শত সাপের আবাস। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের এ ভবনটিই দেশের একমাত্র ভেনম রিসার্স সেন্টার বা সাপের বিষ গবেষণা কেন্দ্র।

 

সেন্টারটির মূল অংশে গা ছমছম শীতল পরিবেশ। সংরক্ষিত এই কক্ষে অনুমতি ছাড়া প্রবেশ নিষেধ। পুরো সেন্টারে আলাদা আলাদা বাক্সে রাখা হয়েছে সাপগুলো আরও রয়েছে ইঁদুরের খামারও। এখানে রয়েছে ৩৫০ টি সাপের বসবাস। এই সাপদের এখানেই লালন পালন করা হয়।

 

ভেনম রিসার্স সেন্টারের ইতিহাস ও কার্যকারিতা

প্রথমেই জেনে নেই কিভাবে ৪টি সাপ থেকে শুরু হয়ে সারাদেশ থেকে ৩৫০টি বিষধর সাপ সংগ্রহ করা হল।

একদম শুরুতে ৪টি মাত্র কোবরা সাপ দিয়ে শুরু করে এখন বাংলাদেশের যত ধরণের বিষাক্ত সাপ রয়েছে যেমন কোবরার দুটো ভ্যারাইটি, ক্রেইটের পাচ ভ্যারাইটি, গ্রিন পিগ ভাইপারের দুই ভ্যারাইটি এবং রাসেলস ভাইপার সহ সকল প্রজাতিরই ১১টি বিষধর সাপের সকল ধরণের প্রজাতিই এই সেন্টারে সংরক্ষিত আছে। 

এই সাপগুলো সংগ্রহ করাটাও ছিল একটা বড় চ্যালেঞ্জ। যেহেতু সকল প্রজাতির সাপ বাংলাদেশের সকল অঞ্চলে পাওয়া যায় না তাই প্রতিটি সাপকে বিশেষ এলাকা অনুসারে জিপিএস ধরে সনাক্ত করতে হত যাতে যখন এই সাপগুলোর ভেনম বা বিষ সংগ্রহ করা হবে সেই প্রত্যেকটি ভেনম যাতে সাপগুলোর ভৌগলিক অবস্থানভেদে কার্যকর হয়।  

এই সেন্টারে মূল ঘরে বসবাসের পূর্বে সাপগুলোকেও প্রথমে দুই মাস কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়। এ সময়ে সাপগুলোর উপরে চলে নানা রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা। কোয়ারেন্টাইন পিরিয়ডে সাপগুলো যদি সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষাগুলো করার পরে সুস্থ থাকে, রোগমুক্ত থাকে তাহলে সাপগুলোকে সার্পেন্টেরিয়াম অর্থাৎ মূল ঘরে বসাবাসের জন্য নিয়ে আসা হয়।

একেক সাপের বৈশিষ্ট্য একেক রকম, কোনটি মানুষের চোখে চোখ রেখে ফোঁস ফোঁস করে, কোনটি আবার অলস পড়ে থাকে। যেমন রাসেল ভাইপারের কথাই ধরুন, সাপটি দেখতে অত্যন্ত সুন্দর, এটির গায়ের রং ধূসর, এটি আরামপ্রিয়। আবার ধরুণ অত্যন্ত ঘন জঙ্গলে হাটতে হাটতে একটি সাপ দেখা গেল, সেটি আপনার সামনে আপনার চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে আছে সেটা কিং কোবরা হতে পারে।


পৃষ্ঠা ১


 

এত এত সাপের খাবার কি?

খাদ্যেও রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন পছন্দ। কোনটি ইঁদুর, কোনটি আবার একদিনের মুরগির বাচ্চা, কারো কারো আবার নিজ প্রজাতির সাপই পছন্দ। কোবরার দুটি ধরণই ইঁদুর এবং মুরগির বাচ্চা খেয়ে থাকে, আবার ভাইপার যে সাপগুলো রয়েছে যেমন রাসেলস ভাইপার এবং পিট ভাইপার এই সাপগুলো সাধারণত জীবিত ইঁদুর খেতে পছন্দ করে। এই রিসার্স সেন্টারের সাপগুলোকে সাধারণত ইঁদুরের বাচ্চা, প্রাপ্তবয়স্ক ইঁদুর এবং মুরগির বাচ্চা এই তিন প্রকার খাবার দেয়া হয়ে থাকে।

রির্সাস সেন্টারে রাখা সবগুলো সাপের জন্য মাসে প্রায় এক লক্ষ টাকার খাবার প্রয়োজন হয়। পাশেই ইঁদুরের খামারে প্রতিমাসে তিন হাজার ইঁদুর জন্মাচ্ছে। সাপ যখন বাচ্চা দেয় তখন বাচ্চা সাপগুলোকে পিংকি ইঁদুর খেতে দেয়া হয়। মূল ঈঁদুরের একদিন বয়সের বাচ্চাগুলোকে পিংকি বলা হয়। আর প্রাপ্তবয়স্ক সাপগুলোকে বড় ইঁদুর খেতে দেয়া হয়। সেন্টারটিতে প্রতি মাসে প্রায় সাড়ে তিন হাজার ইঁদুর জন্মানো হয়, এদের মধ্যে দুই হাজার ইঁদুর ব্যবহৃত হয় সাপের খাবার হিসেবে আর বাকি যে এক হাজার ইঁদুর আছে সেগুলোর মধ্যে ৫০০ ইঁদুর পরবর্তী প্রজননের জন্য ব্যবহৃত হয় এবং বাকী ৫০০ ইঁদুর গবেষণার কাজে ব্যবহৃত হয়।

 

এত এত সাপের নিরাপত্তা কেমন করে দেয়া হয়, কারণ বাইরেই হাসপাতালে শত শত রোগী রয়েছে?

এই যে সার্পেন্টেরিয়াম বা যেটিকে সাপের ঘর বলা হয় এটিতে মূলত ছয় স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিদ্যমান রয়েছে। এখানে যে সাপগুলো থাকে বলা যায় সেগুলোকে প্রায় ফাইফ স্টার সুযোগ সুবিধা দিয়ে রাখা হয়।

 

গবেষণায় সাপের বিষ যেভাবে সংগ্রহ করা হয়?

সাপ যদি কোন ভাবে চায় যে সে বিষ দিবে না তখন কিন্তু সাপের থেকে বিষ বের করা যায় না। একারণে একটি সাপেরই একেক সময় বিষের পরিমাণ বিভিন্ন রকম হয়।

 

বাংলাদেশে প্রাপ্ত সামুদ্রিক সাপ

এতক্ষণ তো আলোচনা করলাম ডাঙ্গার সাপ নিয়ে সমুদ্রের সাপ কতটা ভয়ংকর তাও এবার জেনে নেই। বঙ্গোপসাগরে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৮ প্রজাতির সামুদ্রিক সাপ পাওয়া গেছে যেগুলো খুবই বিষধর। স্থলে বা মিঠা পানিতে যে সাপগুলো পাওয়া যায় সেগুলোর অধিকাংশই নির্বিষ কিন্তু সামুদ্রিক সাপের ক্ষেত্রে উল্টো। অধিকাংশ সামুদ্রিক সাপই বিষধর।

 

ভেনম রিসার্স সেন্টারের গুরুত্ব

বিশ্বের প্রধান সাপ উপদ্রুত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। প্রতিবছর দেশে ৪ লাখ মানুষকে সাপে কাটে তাদের মধ্যে প্রায় ৭ হাজার মানুষ মারা যায়। আর সেকারণেই দেশের এই একমাত্র এন্টিভেনম সেন্টারের এত গুরুত্ব।


পৃষ্ঠা ২



বাংলাদেশ সরকার যদি বাণিজ্যিকভাবে এন্টিভেনম তৈরি করতে পারে তাহলে বাংলাদেশ বাণিজ্যিকভাবে আশেপাশের দেশগুলোতেও এন্টিভেনম সরবরাহ করতে পারবে। কারণ সাপ দক্ষিণ এশিয়ার একটা বড় সমস্যা। ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা প্রত্যেকটা দেশেই প্রাপ্ত সাপগুলোর কমন কিছু ভেরিয়েশন আছে। সুতারাং এন্টিভেনম প্রজেক্টটি বাণিজ্যিকভাবে একটি লাভজনক প্রজেক্টও হতে পারে। বিভিন্ন রকমের ঔষুধ তৈরিতে সাপের বিষ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন বিভিন্ন ধরণের পেইন কিলার তৈরিতে এটা প্রয়োজন হয়, ক্যান্সারের চিকিৎসায় অনেক কেমোথেরাপি এজেন্সিতে এটা ব্যবহৃত হয়।  

 

এন্টিভেনমের কার্যকারিতা যেভাবে পরীক্ষা করা হয়

এবার চলুন যাই রিসার্স সেন্টারের পাশেই অবস্থিত Animal Immunization Lab এ।


ভেনম রিসার্স সেন্টারে সাপের যে বিষ সংগ্রহ করে প্রকৃয়াজাত করা হয় তা মূলত এই ল্যাবে এনে বিভিন্ন প্রাণির দেহে প্রয়োগ করে এন্টিবডি তৈরির কাজটি এই সেন্টারে করা হয়। এখন পর্যন্ত গবেষণা করে যে এন্টিভেনম পাওয়া গেছে তা এই ল্যাবে এনে মুরগি ও ছাগলের উপরে প্রয়োগ করা হয়েছে। মুরগিতে প্রয়োগ করার পরে দেখা গেছে যে সাপের বিষ নেয়ার পর মুরগি বেঁচে ছিল এবং শরীরে এন্টিবডিও ডেভলপ করতে পেরেছে।

 

প্রকৃতিতে বসবাস করা সাপের বিষ আর এই সেন্টারে লালন করা সাপের বিষে পার্থক্য আছে কি? এখানকার এন্টিভেনম কি প্রকৃতিতে পাওয়া সাপের ক্ষেত্রে কাজ করবে?

এক্ষেত্রে যে পদক্ষেপ নেয়া হয় তা হল প্রকৃতি থেকে সাপ ধরার পর সর্বপ্রথম যে বিষটা সংগ্রহ করা হয় সেটিকে স্ট্যান্ডার্ড বিষ হিসেবে ধরা হয়। এরপর যখন সাপটিকে রিসার্স সেন্টারে লালন পালন করা হয় তখন নির্দিষ্ট সময় পরপর সাপ থেকে বিষ সংগ্রহ করা হয় এবং স্ট্যান্ডার্ড বিষ থেকে এর পার্থক্য কতটুকু তা পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়।

 

ভেনম রিসার্স সেন্টারের ভবিষ্যত

২০১৮ সালের মার্চে শুরু হওয়া এ প্রকল্প শেষ হবে এবছরই। তবে এই গবেষণা কাজটি আরও বড় আকারে করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা যায়। সেন্টারটিতে প্রায় ৩৫০টি সাপ আছে, এগুলোর প্রজনন, লালনপালন এবং গবেষণা কাজটি আরও সম্প্রসারিত করার জন্য সম্প্রতি ডিজি হেলথ এর NCDC ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রকল্পের স্থান দেখে যাওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে পর্যাপ্ত জায়গা নিয়ে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে বহুতল বিল্ডিং সমৃদ্ধ একটি এন্টিভেনম রিসার্স সেন্টার করার পরিকল্পনা রয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীও বক্ত করেছেন যে বিদেশি নির্ভরতা কমিয়ে সাশ্রয়ী এন্টিভেনম তৈরি করতে চায় সরকার। এতে বাংলাদেশ সরকারের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ী হবে, বিদেশি নির্ভরশীলতা কমে যাবে।সাপের বিষ দিয়ে শুধু এন্টিভেনম নয় অনেক দামি ঔষুধও তৈরি হয়।

এখনও বাংলাদেশে সাপের দংশনের পরে এর চিকিৎসা নিয়ে রয়েছে নানা কুসংস্কার। ভেনম রিসার্স সেন্টারে অর্ধযুগ ধরে চলছে গবেষণা, কি করে সাপের বিষের প্রতিষেধক তৈরি করা যায়। এখানকার চিকিৎসক আর গবেষকরা প্রত্যাশা করছেন এই সেন্টার থেকে একসময় বাংলাদেশের সাপের দংশনের ফলে যে বিষক্রিয়া হয় তার প্রতিশেষক উৎপন্ন করা সম্ভব হবে।

          

***** সমাপ্ত ***** 

إرسال تعليق (0)
أحدث أقدم