সারমর্ম: হ্যামিলনের রহস্যময় সেই বাঁশিওয়ালার সাথে ওয়াদা রক্ষা না করার পরিণতি। মোট- ৭ পৃষ্ঠা
এই কয়দিন আগেও জার্মানি নামে দুটো দেশ ছিল। অনেকটা
কোরিয়ার মতো। পূর্ব জার্মানি ও পশ্চিম জার্মানি। এখন দুটোই একটি দেশ। সেই জার্মানিরই
এই লোককাহিনীটি দুনিয়ার এমন কোন দেশ নেই যেখানকার শিশু-কিশোরদের জানা নেই। এবার আমরা
সেই বিখ্যাত গল্পটিই আরও একবার শুনবো।
হ্যামিলন ছিল পৃথিবীর এক আশ্চর্য সুন্দর শহর। শহরটি
যেমন সুন্দর ছিল তেমনই ভালো ছিল এই শহরের লোকগুলো। সুখে শান্তিতে বেশ ভালোই দিন কেটে
যাচ্ছিল সবার।
কিন্তু হঠাৎ করেই ঘটলো এক ঘটনা। ছোট বড় নানা প্রকার
ইঁদুরের উৎপাতে অস্থির হয়ে উঠেছিল লোকজন। কেউ হয়তো বিছানা থেকে নামতে নিচে পা বাড়ালো,
অমনি পা পড়লো ইঁদুরের উপরে। কেউ হয়তো ঘুমিয়েছে রাতে- অমনি ইঁদুরের দল এসে বিছানা-বালিশ
কেটে ফেলল কুটকুট করে। হয়তো খাবার খাচ্ছিল কেউ- পড়ল এসে থালায় এক ইঁদুর! ঘরে ইঁদুর,
বাইরে ইঁদুর।
ইঁদুর ঘুরছে প্যান্ট-শার্টের পকেটে। মানুষের খাবার
দাবার মূহুর্তেই সাবাড় করে ফেলছে তারা। ইঁদুরের অত্যাচারের ফলে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠল
হ্যামিলনের লোকজনের।
শুধু মানুষ নয় পশু প্রাণীরাও ইঁদুরের ভয়ে আতঙ্কিত।
যেমন- একদিন একদল ইঁদুর মিলে আক্রমণ করে বসলো পাগলা এক কুকুরকে। কুকুরটা প্রাণভয়ে পালাচ্ছে।
পেছনে ক্ষ্যাপা ইঁদুরের দল।
বিড়াল দেখলে ইঁদুর পালায়। কিন্তু হ্যামিলনের ইঁদুররা
এক হুলো বিড়ালকে আক্রমণ করে মেরেই ফেললো।
ইঁদুরের জ্বালায় ঘরে থাকা যায় না। অফিসে, আদালতে,
পার্কে, স্কুলে সবখানেই একই যন্ত্রনা।
নিরিবিলি এক মিনিট বসে থাকার জায়গা নেই সারা হ্যামিলনে।
কিলবিল করে ইঁদুরের দল উঠে আসে শরীরে।
ভারি মুশকিল!
ভারি যন্ত্রনা!
এর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য শহরের গন্যমান্য লোকেরা
মিলে মিটিংয়ে বসলো। উপায় কিছু একটা বের করতেই হবে। ইঁদুরের উৎপাত থেকে রক্ষা করতে হবে
হ্যামিলন শহরকে। মুক্তির পথ একটা বের করতেই হবে।
হ্যামিলন শহরের মেয়র চুপ করে বসে আছেন চেয়ারে। গভীর
দুশ্চিন্তার ছাপ তার চোখে মুখে। কোটি কোটি ইঁদুরের বিরুদ্ধে লড়াই!
মিটিং এ উপস্থিত হয়েছে হ্যামিলনের সবাই। উৎকন্ঠিত
চেহারায় তাদের মেয়র তখন মাথায় হাত দিয়ে চেয়ারের হাতল ধরে বসে আছেন। মুখে কোন কথা নেই
তার। সকলের সামনে উঠে দাঁড়ালেন। অধিবাসীদের উদ্দেশ্যে বলা শুরু করলেন:
‘আজ বড় দুর্দিন আমাদের। আপনাদের কষ্ট মানে আমাদেরই কষ্ট। কি নিদারুণ এবং ঘোর দুঃখ-জ্বালা-যন্ত্রণার মধ্যেই না আমাদের দিন কাটছে! ইঁদুর অতিষ্ট করে তুলছে আমাদের জীবন। আমরা সর্বদা ভীত। খুট করে করে একটু আওয়াজ হলেই মনে হয় এই বুঝি তেড়ে এল ইঁদুরেরা। রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে আসে আমার। ইঁদুর যে এরকম দুঃসহ করে তুলতে পারে আমাদের জীবন, একথা কে কবে কোথায় ভেবেছে বলুন?
পৃষ্ঠা ১/ ৭
আপনারা আমাকে দোষারোপ করছেন। স্বীকার করে নিচ্ছি সব
দোষ আমার। সমাধানের পথ বের করতে বলছেন আমাকেই। আমি তো আপনাদেরই একজন। আপনারাই আমাকে
পথ বলে দিন। এরকম নির্মম কষ্টসহ্য করা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। আমি পালিয়ে যেতে চাই
এই শহরে ছেড়ে......!’
কথা শেষ করে চেয়ারে বসে পড়লেন মেয়র। কান্নায় ভেঙে
পড়েছেন তিনি। সভায় উপস্থিত লোকজনেরা সবাই হতবাক। ইঁদুরের হাত থেকে মুক্তির উপায় বের
করতে হবে, ভাবছে সবাই।
সভার কাজ চলতে চলতেই টের পাওয়া গেল, এখানেও ইঁদুরের
উৎপাত। টেবিলের উপরে, চেয়ারের নিচে, ঘরের মেঝেতে তাদের কিচিকিচি রব।
এরমধ্যে একজন বললো, কল! কল বানাতে হবে। অসংখ্য ইঁদুর
ধরার জন্য কল বানাতে হবে।
প্রস্তাব শুনেও কেউ কোন সাড়া দিল না। এক মিনিট, দুই
মিনিট, তিন মিনিট- সময় গড়িয়ে চলেছে তার আপন গতিতে। ঠিক এমন সময়- দরজায় শোনা গেল কড়া
নাড়ার শব্দ। ঠক, ঠক, ঠক।
সচেতন হয়ে উঠল সভাকক্ষে বসে থাকা লোকগুলো। ইঁদুরের
দল কি টের পেয়ে গেছে- ওদের বিরুদ্ধেই চলছে এখানে ষড়যন্ত্র?
আবারও শব্দ! কিসের শব্দ? কান পাতলো সবাই। মেয়র ও সভার
অন্যান্যরা মনোযোগ দিয়ে শুনলো সেই একই শব্দ- ঠক ঠক ঠক!
একজন মেয়রের দিকে তাকিয়ে অনুমতি চাইলেন, দরজা কি খুলে
দেব?
ভীত মেয়র দরজা খোলার ইশারা করলেন। দরজা খুলতেই সবাই
অবাক হয়ে গেল। দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে অদ্ভুত এক লোক। লোকটা যেমন লম্বা তেমনই রোগা।
উষ্কখুষ্ক লম্বা চুল, কোঁকড়ানো সেই চুলে তেল চিরুনি পড়েনি বহুদিন। গালে তার খোঁচা খোঁচা
দাড়ি। শরীরের রং ধূসর। ময়লার আস্তরন শরীরে, গায়ে তার লম্বা আলখাল্লা। অর্ধেক লাল, অর্ধেক
হলুদ সেই পোশাক। দুই হাতে ফুল-তোলা কাজ। গলায় ঝুরি ঝুরি রঙ্গিন কাপড়ের ঝালর। পরনে তার
শতছিন্ন একটি পাজাম। দেখলেই মনে হবে, জগৎসংসারে কেউ নেই তার।
চোখে মুখে সর্বদাই তার মৃদু হাসি। মাথায় তার লাল নীল
রঙ্গিন একটা টুপি। কোন চিন্তাভাবনা যেন তার নেই।
সে হাসতে হাসতেই এগিয়ে এলো একেবারে মেয়রের কাছাকাছি।
মাথাটা একটু ঝাঁকিয়ে নত হয়ে দাঁড়াল।
মেয়র জিজ্ঞেস করলেন- ‘কি চাই তোমার?’
এইবার লোকটা বললো, ‘আপনারা যদি অনুমতি দেন, তবে আমি
কিছু বলতে চাই।’
মেয়র হ্যাঁসূচক সম্মতি দিয়ে মাথা নাড়ালেন।
লোকটি বলল- ‘আমি একজন নগণ্য লোক। আপনারা নামিদামি মানুষ। কিন্তু আমার অদ্ভুত রকমের একটি ক্ষমতা আছে। যে কোন জীবজন্তুকে আমি বশ করতে পারি। বিশেষ করে যেসব প্রাণী মানুষের ক্ষতি করে তাদের প্রতি বিশেষভাবে প্রয়োগ করি আমার জাদুর বাঁশির ক্ষমতা। এজন্যই লোকে আমায় বলে, বাঁশিওয়ালা। জাদুর বাঁশি আমার হাতে। এই যে দেখুন আমার বাঁশি।’
পৃষ্ঠা ২/ ৭
সবাই তখন খেয়াল করে দেখল, সেই অদ্ভুত লোকটির হাতে
রয়েছে একটি সরু এবং সুন্দর বাঁশি।
লোকটা আরও বলল, ‘দেশ থেকে দেশ আমি ঘুরে বেড়াই। পশুপাখির
অত্যাচার থেকে উদ্ধার করতে চেষ্টা করি লোকজনদের।’
মেয়র তখন বললেন, ‘আমাদের এখানে ইঁদুরের অত্যাচার-
কি বলবো ভাই, দারুণ কষ্টে আছি।’
লোকটি বলল- ‘আমাকে এসব বলতে হবে না। আমি সব
জানি। আমি ইঁদুরের অত্যাচার থেকে আপনাদের উদ্ধার করতেই এসছি। কিন্তু আমার একটি শর্ত
আছে।’
মেয়র বলল- ‘কি শর্ত? সব শর্তই আমরা মানতে রাজি
আছি।’
বাঁশিওয়ালা- ‘না, তেমন কোন ব্যাপার নয়। এর জন্যে
আপনাদের কিছু টাকা খরচ করতে হবে।’
মেয়র- ‘কত টাকা?’
বাঁশিওয়ালা- ‘দশ হাজার সোনার মুদ্রা!’
মেয়র- ‘মাত্র দশ হাজার সোনার মুদ্রা! এ
আর এমন কি ব্যাপার! শিগগির-শিগগির আপনি ইঁদুরগুলোকে ঘায়েল করুন। দশ হাজার নয় আমরা আপনাকে
পঞ্চাশ হাজার সোনার মুদ্রা দেব।’
মিটিমিটি হেসে আবারও বাঁশিওয়ালা তাকালো সবার দিকে।
বাঁশিতে ফুঁ দিল সেই অদ্ভুত লোকটি। কেঁপে কেঁপে একটা
মিষ্টি সুরেলা ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ল আকাশে বাতাসে।
আবার ফুঁ দিল জোরে, বেশ জোরে, আর অমনি- মোহিনী সুরের
টানে ঘটতে লাগল অদ্ভুত এক কাণ্ড। হ্যামিলনের সব ইঁদুরের কানে গিয়ে যেন পৌঁছাল সেই
ধ্বনি।
ইঁদুর দলের কিচিকিচি শব্দ বেড়ে হল দুইগুণ, তিনগুণ,
চারগুণ-শতগুণ। যেন এক ইঁদুরের মিছিল। সেই মিছিলে শরিক হতেই হবে সবাইকে।
ধীরে ধীরে ইঁদুরের বাহিনী বিশাল থেকে বিশালতর হতে
লাগল।
হ্যামিলনবাসী দেখল, শহরের প্রতিটা জায়গা থেকেই ইঁদুররা
এসে জড়ো হচ্ছে বাঁশিওয়ালার পাশে। ইঁদুরের ঢল নেমেছে আজ। ছোট, বড়, মাঝারি, লম্বা, সরু,
মোটা সবাই চলছে গায়ে গা মিলিয়ে। খয়েরি রঙের সবচেয়ে বুড়ো যে ইঁদুরটি সেও চলেছে লেজ পুটুশপাটুশ
করে। দোলনায় বসে যে ইঁদুরটি ঘুমাচ্ছিল তারও ঘুম ভেঙ্গে গেল চট করে। সেও ছুটলো তড়িঘড়ি
করে। কাঠের তলায় লুকিয়ে থাকা যে ইঁদুরের দল মনের সুখে খাচ্ছিল পনির আর মাখন, তারাও
ছুটলো।
ঝোপঝাড় পেরিয়ে ছুটতে গিয়ে অনেক ইঁদুর হল ক্ষতবিক্ষত।
লোভ এবং হিংসা ভুলে চলল তারা সারি বেঁধে পাশাপাশি।
বাঁশি বাজাতে বাজাতে সেই বাঁশিওয়ালা তখন এগিয়ে চলল
সামনে। সুরের ধ্বনি বেড়ে চলেছে ক্রমেই। দূর বহুদূরে যেন সেই ধ্বনি ছুটেছে। হেলে দুলে,
নেচে নেচে বাঁশিওয়ালা চলল। তার পেছনে ইঁদুরের দল। সারি বেঁধে ধীরে সুস্থে চলছে সবাই।
যেতে যেতে, যেতে যেতে- নদীর তীরে এসে দাঁড়ালো বাঁশিওয়ালা।
সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করছে নদীর পানি।
বাঁশিওয়ালা পেছন ফিরে দেখল, তাকে ঘিরে রেখেছে ইঁদুরের
দল। পেছনে দীর্ঘ ইঁদুরের মিছিল।
বাঁশিওয়ালার জাদুর বাঁশি আরো জোরে জোরে বাজতে লাগলো।
পৃষ্ঠা ৩/ ৭
বাঁশিওয়ালা তখন নদীর তীর ধরে আস্তে আস্তে নামতে লাগল
পানিতে। এক পা, দুই পা, এইভাবে এগুতে এগুতে সে গেল হাটু পানিতে। ইঁদুরের দল হুড়মুড়িয়ে
পড়ল পানির স্রোতে। বাঁশিওয়ালা যত এগোয় ইঁদুরের দলও তত পানিতে পড়ে। পানির স্রোতে ভেসে
যায় তারা।
বাঁশির সুর বাজছে। মায়াময় সেই সুরের টানে ইঁদুররা
ঝাঁপিয়ে পড়েছে নদীর পানিতে। ঝাঁপিয়ে পড়েই স্রোতের টানে ভাসতে ভাসতে চলে তারা। পানিতে
বারকয়েক হাবুডুবু খেয়েই তলিয়ে গেল ইঁদুরগুলো। গভীর জলের টানে হারিয়ে গেল হ্যামিলনের
অত্যাচারী ইঁদুরেরা।
শেষ ইঁদুরটা যখন খোঁড়াতে খোঁড়াতে এসে পানিতে নামল,
তখনই বাঁশির সুর বন্ধ হল।
সব ইঁদুরই কি মারা গিয়েছিল সেদিন?
না, একটি ইঁদুর বেঁচে গিয়েছিল। বেশ নাদুসনুদুস, হৃষ্টপুষ্ট
তাগড়া সেই ইঁদুরটা নদীর জলে নেমেছিল ঠিকই কিন্তু সে বেঁচে গেল। গায়ে তার প্রচন্ড শক্তি
ছিল বলে অনেক কষ্টে সাঁতরাতে শুরু করে এবং ইঁদুরবাহিনীর মধ্যে একমাত্র সে-ই বেঁচে রইলো।
বেঁচে থাকা ইঁদুরটি বলে বেড়াত নানা গল্প।
অবশেষে হ্যামিলন শহরে নেমে এলো শান্তি।
গভীর প্রশান্তি দেখা দিল মানুষের মনে। ইঁদুরহীন এক
শহর। নেই কোন উৎপাত, জ্বালা-যন্ত্রণা। শহরটি যেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। যেন এইমাত্র কেউ
এসে সাফ করে দিয়েছে।
হ্যামিলনবাসীর মনে ফিরে এলো আনন্দ। সবাই যে যার ঘরদোর
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজে ব্যস্ত হয়ে রইলো।
আজ বড় সুখের দিন। আজ বড় আনন্দের দিন। আজ উৎসব হবে
হ্যামিলনে। আনন্দ-উৎসব।
হ্যামিলন শহরের যিনি মেয়র, তারও যেন কাজের শেষ নেই।
তিনি হুকুম দিচ্ছেন রাস্তাঘাট পরিষ্কার করার জন্যে। যত গর্ত এবং ফাঁক ফোকর আছে, সব
বন্ধ করে দিতে হবে, যেন আর একটি ইঁদুরও হ্যামিলনে প্রবেশ করতে না পারে।
আর অমনি- সেই বাঁশিওয়ালা এলো মেয়রের কাছে। মুখে তার
লাজুক এবং রহস্যময় হাসির খেলা। তার কথা বুঝি ভুলে গেছে সবাই। এই আনন্দ-উৎসবে অদ্ভুত
বাঁশিওয়ালার কথা আজ কে মনে রাখে!
অদ্ভুত পোশাক পরনের সেই বাঁশিওয়ালা মেয়রকে বলল, আমার
পাওনা মিটিয়ে দিন। আমার অনেক কাজ। আমি চলে যাব। মেয়র তাকাল সে বাঁশিওয়ালার দিকে- ‘কি দিতে হবে তোমায়?’
বাঁশিওয়ালা মৃদু হেসে বলল, ‘কি দেবেন মানে? মাত্র দশ হাজার
সোনার মোহর- কথা তো এই-ই ছিল! ভুলে গেলেন নাকি!’
মেয়র- ‘কত? কত বললেন? দশ হাজার! বলেন কি
আপনি? এত টাকা দেয়া সম্ভব নয়।’
বাঁশিওয়ালা অবাক হয়ে বলল, ‘আপনারাই কিন্তু রাজি হয়েছিলেন।
বরং আপনারা বলেছিলেন দশ নয় আমাকে পঞ্চাশ হাজার মোহর দেবেন আপনারা।’
মেয়র- ‘বলেছিলাম বটে! আমরা তখন দিশেহারা ছিলাম, তাই কি বলতে কি বলেছি!’
পৃষ্ঠা ৪/ ৭
বাঁশিওয়ালা এবার তীক্ষ্ণচোখে মেয়রের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আমার পাওনা মিটিয়ে দিলেই আমি চলে
যাব। আমি কম কথার মানুষ। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা আমি পছন্দ করি না।’
মেয়র- ‘কিন্তু তোমাকে দশ হাজার দেয়া সম্ভব
নয়। আজ এখানে দারুণ উৎসব হবে। প্রচুর খরচাপাতি আমাদের। তুমিও না হয় আমাদের আনন্দে অংশগ্রহন
কর।’
‘আমার পাওনা মিটিয়ে দিন’, গম্ভীরভাবে বলল বাঁশিওয়ালা।
‘কিসের পাওনা?’ যেন একরাশ বিরক্তি ঝরে পড়ল মেয়রের
কথা থেকে- ‘তুমি তো শুধু বাঁশি বাজালে। ইঁদুরগুলো তো গিয়ে পড়ল
ঐ আমাদের নদীতেই। সত্যি কথা কি- ইঁদুরগুলো তো আর ফিরে আসবে না আমাদের শহরে। কিন্তু
আমরা অকৃতজ্ঞ নই। আমরা তোমার কথা মনে রেখেছি। দশ হাজার না হলেও কিছু সোনার মোহর তোমায়
দেব।’
বাঁশিওয়ালা বলল- ‘কিছু নয়, আমায় পুরোপুরিই দিতে হবে।’
মেয়র- ‘কি করে দেব বলো তোমায়? কি আছে আমাদের?
ইঁদুরেরা সবকিছু ধ্বংস করে দিয়ে গেছে।’
বাঁশিওয়ালা- ‘কিন্তু আপনারা তো সজ্ঞানেই প্রতিজ্ঞা
করেছিলেন আমার পাওনা দেয়ার জন্য।’
মেয়র- ‘তুমি দেখছি নাছোড়বান্দা লোক। বুঝিয়ে
বলছি- তাও বুঝছো না!’
বাঁশিওয়ালা- ‘আমি কিছু বুঝতে চাইনা।’
মেয়র- ‘পঞ্চাশ বা একশোটা সোনার মোহর দিই
তোমায়। এই দিয়েই কিছু খেয়ে নিও তুমি।’
বাঁশিওয়ালা এবার আকাশ থেকে পড়ল। ভীষণ অবাক সে! মনে
মনে ভাবলো , বলে কি মেয়র লোকটা! বাঁশিওয়ালার খুব রাগ হল!
বাঁশিওয়ালা মেয়রকে বলল- ‘আমাকে ঠকানোর কোন চেষ্টা করবেন
না। এতে আপনাদের অমঙ্গল হবারই সম্ভবনা বেশি। আমি তো আগেই বলেছি-আমি জাদুকর বাঁশিওয়ালা।
আমি দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়াই। আপনারা জানেন না, আমার বাঁশিতে অন্যরকম সুরও বাজে।
ভয়ংকর সুন্দর সুর।’
মেয়র এবার রেগে গেলেন। বললেন- ‘কি এমন সুর বাজে তোমার বাঁশিতে?
যাও সেই সুর বাজাও তুমি। একশো মোহর নিলে নাও নইলে বিদায় হও। আমরা এখন আনন্দ উৎসব করবো।
বিশাল উৎসব।’
বাঁশিওয়ালা কিছুই বলল না। কথা বাড়াল না সে আর। মলিন
এবং বিষন্ন মুখে নেমে এলো রাস্তায়। মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা তার পছন্দ নয়।
এবার সে অন্য একটি বাঁশিতে সুর তুললো। প্রাণকাড়া মনকাড়া
সেই সুর। সুর ছড়িয়ে পড়ল প্রাণে প্রাণে। সুরের মায়া ছেয়ে ফেলল হ্যামিলন শহর।
হ্যামিলনের শিশুরা চঞ্চল হয়ে উঠল। ছুটোছুটি শুরু করলো
তারা। এত মায়াবি বাঁশির সুর আসে কোত্থেকে? কে ডাকে অমন করে? কে, কে! ডাকে আমাকে।
ছেলেমেয়েরা ছুটে আসতে থাকে বাঁশিওয়ালার কাছে। শুরু হয়েছে তাদের কলরোল, তাদের উচ্ছাস, তাদের হইহুল্লোর।
পৃষ্ঠা ৫/ ৭
খেলা ভুলে ছুটলো একটি শিশু। মায়ের কোল থেকে দৌড় শুরু
করলো একজন। একটি শিশুর হাত থেকে উড়ে গেল রঙিন একটি ঘুড়ি। যে ছেলেটি সন্ধ্যাবেলা জোনাক
পোকা কুড়াত সেও ছুটলো। যে ছেলেটি গান গাইতো সকালে উঠে, সেও সুরের ঝর্ণাধারায় আন্দোলিত।
মায়ের আদরের দাগ মুছে নিয়ে ছুটে এল একটি শিশু। ক্লাসের দুষ্টু ছেলেটি- যেন তারও আনন্দের
কোন শেষ নেই। সবচেয়ে দুঃখী যে ছেলেটি হ্যামিলনের পথে পথে দেয়াশলাই বিক্রি করতো- সেও
ছুটলো। তারও আনন্দ যেন আর ধরে না।
মা নেই, বাবা নেই- একা একা যে ছেলেটি বেড়ে উঠেছিল
ফুটপাতে সেও ছুটছে। মন যে আজ কেমন করে কেউ জানে না। কেউ বোঝে না মনের খেলা।
বাঁশিতে সুর উঠছে আরো তীব্রভাবে। আরো হৃদয়ভেদী সে
সুর। সুরে সুরে জাগলো শিশুদের হাসি। বাঁশি বাজছে। সবাই সুরে সুর মেলাচ্ছে। আকুল করা
সেই সুরের ডাক। লাটিম ফেলে, লাটাই ফেলে ছুটলো শিশুরা। ভাইবোন গলা ধরে ছুটছে। ছুটতে
ছুটতে জুতা খুলে গেল কারও পায়ের। কারো খুলে গেল জামার বোতাম। কেউ পড়ল আছড়িয়ে। কেউ পড়ল
পা পিছলে। তবু চলার কোন বিরাম নেই।
হ্যামিলনবাসী অবাক হয়ে দেখল, কি আশ্চর্য ব্যাপার!
শিশুরা দল বেঁধে চলেছে বাঁশিওয়ালার পেছনে পেছনে। কোথায় যাচ্ছে তারা। ইঁদুরের মতোই কি
শিশুদের পরিণতি হবে। ভয়ে নির্জীব হয়ে গেল হ্যামিলনবাসী।
বাঁশিওয়ালা এবারও কি যাচ্ছে ওয়েসার নদীর কূলে? এবার
কি শিশুর দলই ডুবে মরবে পানিতে?
এ হতে পারে না। থামাও থামাও এ বাঁশিওয়ালাকে। দশ হাজার
নয়, পঞ্চাশ হাজার নয়, ওকে লক্ষ সোনার মোহর দাও। ওকে ফিরিয়ে আনো। খ্যাপার মতো, উন্মাদের
মতো কোথায় চলেছে বাঁশিওয়ালা!
কারো কিছুই যেন করার নেই। তাকিয়ে আছে সবাই দূরে। যেন
নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে থাকা। শিশুর দলকে বোঝানো যাবে না। বলা যাবে না ওদের সঙ্গে কথা।
ফেরানো যাবে না ওদেরকে আর।
ঘরের ছেলে কি ঘরে ফিরবে না? কিসের মায়ায় চলেছে ওরা?
কি এমন জাদুমাখা এই বাঁশি!
বাঁশিওয়ালা নদীর তীর ধরেই এগিয়ে চলল। সঙ্গে তার বিশাল
শিশু-কিশোর বাহিনী।
বাঁশিওয়ালা চললো পুবে। পাহাড়ের দিকে। হ্যামিলন শহরে
একটিও শিশু নেই। সব শিশুই চলে গেছে বাঁশিওয়ালার কাছে। সবার মনেই ফূর্তির ঢেউ। সবার
মুখেই উল্লাস।
পাহাড়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াল বাঁশিওয়ালা। বাজলো আরো জোরে বাঁশি। বাঁশির সুরে মৌন পাহাড়ের মনও গলে যায় মোমের মতো। দুই ভাগ হয়ে সরে যায় পাহাড়ের বুক। তৈরি হয় রাস্তা, ফুল বিছানো পথ। চমৎকার সেই ফুলের রাস্তা দিয়ে চলে বাঁশিওয়ালা। পেছনে চলছে শিশুর দল।
পৃষ্ঠা ৬/ ৭
ওরা কি চলেই যাচ্ছে? আর কি ফিরবে না কেউ! ওরা কি একবারের
জন্যেও পেছনে ফিরে দেখবে না স্বপ্নের মতো সুন্দর ওদের প্রিয় হ্যামিলন শহরকে। ওরা কি
চলে যাবে পাহাড়ের ভেতর!
ঠিক ঠিক হলো তাই। সবাই চলে গেল সেই রাস্তা ধরে। নাচতে
নাচতে, গাইতে গাইতে সবাই চলে গেল। তারপর আপনা আপনি বন্ধ হয়ে গেল পাহাড়ের মুখ।
আশ্চর্য ব্যাপার! এইমাত্র এখানে ছিল একটি সুন্দর রাস্তা।
হইচই হচ্ছিল। হাসি আনন্দ হচ্ছিল। এক মূহুর্তে যেন সব উধাও হয়ে গেল। সব মিথ্যে হয়ে গেল।
এখনই যা ছিল সত্যি- এখন সব মিথ্যে! সব মিথ্যে!
কোথায় গেল? কোথায় গেল হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা? হে সুন্দর
শিশুরা! হে আমাদের স্বপ্নেরা! হে হ্যামিলনের আনন্দ! কোথায় গেলে তোমরা! সবাই কি চলে
গেল ঐ পাহাড়ের ভেতর? সবাই কি হারিয়ে গেল?
একটি ছেলে। যে হ্যামিলনের চোখের মণি, প্রাণের টুকরো
হয়ে রয়ে গেল। সে যেতে পারেনি। কারন সে ছিল খোঁড়া। হাঁটতো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। ধীরে ধীরে।
পারতো না দ্রুত ছুটতে। তাই সে সবার পেছনে পড়ে গিয়েছিল। সে যখন পৌঁছায় তখন বন্ধ হয়ে
গেছে পাহাড়ের দরোজা। বন্ধ হয়ে যায় বাঁশির সুর।
তারপর থেকেই মন খারাপ হয়ে যায় ছেলেটার। সবাই চলে গেছে।
আর একটু দেরি করলে কি হত না! আমাকে রেখে কেন ওরা চলে গেল সবাই!
ছেলেটা বলতো, অদ্ভুত আশ্চর্য এক অনুভূতির কথা। যাচ্ছিলো
তারা স্বপ্নের দেশে। আশ্চর্য সুন্দর এক দেশ।
আনন্দ ছাড়া সেখানে আর কিছুই থাকবে না। দুঃখী শিশুটিও
সেখানে হাসবে। থাকবে না কারও অভিযোগ। এরকমই একটা আনন্দনগর সেটা।
‘আহা! কি আনন্দের জায়গা থেকেই না
বঞ্চিত হলাম আমি। হতভাগ্য আমি! দুঃখে কষ্টে হৃদয় ফেটে যায় আমার। কেন আমি খোঁড়া হলাম।
আর একটু এগুলেই আমি চলে যেতে পারতাম পাহাড়ের ঐ পাড়ে। তারপর কত আনন্দ না হতো!’ ছেলেটা সারাক্ষন এসবই বলতো।
ছেলে মেয়েরা হারিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই হ্যামিলনবাসী
টের পেল, কি ভয়ানক ক্ষতি হয়ে গেছে!
তাদের খবর আনো, লোক পাঠাও, খোঁজ আনো। ঘোড়ায় চড়ে পাহাড়ের
দিকে ছুটলো লোকজন।
খবর আনতে হবে। কিন্তু কোথায় খবর? পাহাড়ের গায়ে মিলিয়ে
গেল ঘোড়ার খুরের ধ্বনি। কোন খবর নেই। শুরু হল কান্না। হ্যামিলনবাসীর কান্না। শিশুদের
খবর নেই। সেই যে গিয়েছে তারা বাঁশিওয়ালার সঙ্গে, আর কি ফিরবে তারা কখনো?
বাঁশিওয়ালার সঙ্গে চলে যাওয়া হ্যামিলনের সেই শিশুরা ফেরেনি আর কোনদিন। তবে তারা কি গিয়েছে সুন্দর সেই আনন্দনগরীতে? কেউ জানে না।
***** সমাপ্ত *****
পূর্বের পোষ্ট: পৃথিবীর শেষ ঝর্ণার খোঁজে (ইংল্যান্ডের লোককাহিনী) || লোককাহিনী - ১৭
পরবর্তী পোষ্ট:
‘লোককাহিনী’ ক্যাটাগরির জনপ্রিয় গল্পসমূহ
◉ সাত ভাই চম্পা (বাংলাদেশী রূপকথার গল্প)
◉ ভাগ্যবানের ভাগ্য (ভারতের লোককাহিনী)
◉ গোন ও কোমার বন্ধুত্ব (জাপানের লোককহিনী)
◉ চুলার উপর টাকা (আফগানিস্তানের লোককাহিনী)