সারমর্ম: ছদ্মবেশী এক রাজকুমার যেভাবে তার কাঙ্খিত বধূকে খুঁজে নিলো। মোট-৩ পৃষ্ঠা
দক্ষিন আমেরিকা মহাদেশের একটি দেশ পেরু। এ মহাদেশের
গুরুত্বপূর্ণ জাতি ছিল পেরুর অধিবাসীরা। এক সময়ে তাদের লোককথার প্রাচুর্য ও জনপ্রিয়তা
ছিল। এই দেশেরই এক রাজপুত্র তার নিজের বধু হওয়ার মত এক কন্যাকে খুঁজতে গিয়ে ঘটিয়েছিল
নানান ঘটনা। সেই রাজপুত্রেরই গল্প শুনবো এবার।
এক গরীব অসহায় বৃদ্ধের ছদ্মবেশ ধারন করে রাজপুত্র
পারিয়াকাকা সারা রাজ্যে ঘুরে বেড়ালেন কিন্তু সর্বত্রই তিনি সাক্ষাৎ পেলেন লোভী ও স্বার্থপর
মানুষের। তাঁর ছিন্নবস্ত্র ও সহায় সম্বলহীন অবস্থা কারো মনে করুণার উদ্রেক করলো না।
অবশেষে তিনি এক পাহাড়ের পার্শ্বদেশে একটা খাড়া ঢালের
কাছে এসে পৌঁছলেন। পাহাড়ের নিচে দিয়ে বয়ে গেছে একটা হ্রদ। প্রান্তরের মধ্যদিয়ে সেই
হ্রদের জলধারা বয়ে চলেছে। রাজপুত্র নিচে নেমে গিয়ে গ্রামের বাজারে এক কোণায় বসে বিশ্রাম
নিতে লাগলেন।
চারপাশে গ্রামের মানুষেরা তখন হাসি ও গল্পে মগ্ন।
ক্লান্ত ধূলিধূসরিত বৃদ্ধ মলিন মুখে তার নিজের জায়গায় বসে রইলেন রাজপুত্র, কেউ তার
দিকে বিন্দুমাত্র দৃষ্টি দিল না।
একটু পরে ওই গায়ের সবচাইতে সুন্দরী মেয়েটা ওখান দিয়ে
যেতে যেতে বিষন্ন মনে চুপচাপ বসে থাকা বৃদ্ধকে দেখতে পেয়ে তার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল,
‘কি বাবা, আপনি এখানে চুপচাপ একা
বসে আছেন যে, ওরা কি উৎসবে যোগ দেবার জন্য আপনাকে একবারও আমন্ত্রণ করেনি?’
ছদ্মবেশী যুবরাজ না-সূচক মাথা নাড়তেই মেয়েটি এগিয়ে
এসে শীতল ও বিশাল একটি পাত্র বৃদ্ধকে দিয়ে বলল, ‘বাবা, এটা পান করুন। এটা আমাদের
দেশের সকলের সবচাইতে প্রিয় পানীয়।’
রাজপুত্র শরবত পান করে বললেন, ‘মিষ্টি মেয়ে, তুমি আমার ধন্যবাদ
গ্রহন কর। এই পানীয়টুকু না পেলে আজ আমি হয়তো মারাই যেতাম এবং নিশ্চিৎভাবেই তুমিও মারা
পড়তে। এখন মন দিয়ে আমার কথা শোন। এই গ্রামের উপর একটা ভয়ানক দুর্যোগ নেমে আসছে। তুমি
দ্রুত বাড়ি গিয়ে তোমার পরিবারের সবাইকে নিয়ে আজ রাতেই এই গ্রাম ছেড়ে পাহাড় পেরিয়ে ওপাশের
উপত্যকায় চলে যাও। দেরি করো না। ঐখানে আবার আমাদের দেখা হবে।’
একথা বলেই ছদ্মবেশী রাজপুত্র চোখের নিমিশে কোন দিকে
যে চলে গেলেন কুমারী কন্যা তা বুঝতেই পারলো না। কিন্তু বাসায় এসে কন্যা বৃদ্ধের নির্দেশ
অক্ষরে অক্ষরে পালন করল। পরিবারের সবাইকে নিয়ে সে ওই রাতে গ্রাম ছেড়ে গেল। তারা যখন
গ্রামের সীমানা পেরিয়ে হ্রদের তীরে এসে পৌঁছল, তখন প্রায় সাথে সাথেই হ্রদের একপাশের
জমিতে প্রচন্ড ধস দেখা দিল। প্রবল পানির তোড় বন্যার রূপ নিয়ে গ্রামের দিকে অগ্রসর হলো।
সঙ্গে চলল অসংখ্য হলুদ ও সাদা বিরাট বিরাট শীলা ও নানা আকারের পাথর। দেখতে দেখতে পুরো
গ্রাম নিশ্চিন্ন হয়ে গেল।
পৃষ্ঠা ১/ ৩
কুমারীকন্যা ও তার পরিবারের লোকেরা পাহাড় পেরিয়ে নতুন
অঞ্চলে গিয়ে উপস্থিত হলে সেখানকার মানুষেরা তাদের বিনা দ্বিধায় আশ্রয় দিল। তারপর মাঠে
চাষাবাদ ও খামারের কাজে তাদের সুযোগ দিল। কিন্তু দিনদিন ওই কাজ কঠিনতর হয়ে উঠতে থাকে,
কারণ হ্রদের জলের পরিমাণ একদমই কমে গিয়েছিল। যে ক্ষীণ জলধারা পাহাড়ের গা বেয়ে আসছে
তার সাহায্যে এই শুষ্ক আবহাওয়ায় ওদের চাষ করা ভুট্টার ক্ষেত ওরা আর বাঁচিয়ে রাখতে পারছিল
না।
ওই সময়ে একদিন রাজপুত্র পারিয়াকাকা ওখানে এসে হাজির
হলেন। এখানেও তিনি সেই একই বৃদ্ধের ছদ্মবেশ ধারন করে আছেন। তরুণীকে ভুট্টা ক্ষেতের
এক পাশে বসে অশ্রু বিসর্জন করতে দেখে তিনি বললেন, ‘কী হয়েছে? কাঁদছো কেন তুমি? আমাকে
বল, হয়তোবা আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারবো। তোমার মুখে হাসি ফোটানোর চাইতে বেশি আনন্দ
আমাকে আর কিছুই দেবে না।’
মেয়েটি বলল, ‘বাবা, আমি কাঁদছি কারন জলের অভাবে
আমাদের জমির ভুট্টা মরে যাচ্ছে।’
তখন রাজপুত্র পারিয়াকাকা বললেন, ‘আমি যখন জলের অভাবে তৃষ্ণার্ত হয়ে
মরতে বসেছিলাম তুমি তখন আমার হাতে পানীয় তুলো দিয়ে আমার প্রাণ রক্ষা করেছিলে, এখন তোমার
যা প্রয়োজন তা আমি তোমাকে দেবো। তবে আমাকে একটা কথা দিতে হবে যে তোমার সমস্যার সমাধান
করতে পারলে আমাকে তুমি বিয়ে করবে।’
তরুণী কিছুই বলল না, নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।
রাজপুত্র পারিয়াকাকা আপন মনে হাসলেন, কিন্তু কোন কথা
না বলে পাহাড়ের যে জায়গা থেকে হ্রদ শুরু হয়েছিল সেখানে গিয়ে চুপ করে দাঁড়ালেন। তারপর
তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে কাদের যেন উদ্দেশ্যে বললেন, ’প্রিয় বন্ধুরা, আমাকে সাহায্য কর।
এমন ব্যবস্থা কর যেন এখান দিয়ে সর্বদা পর্যাপ্ত পানি প্রবাহিত হয়। জমি যেন সর্বদা ঊর্বর
থাকে, আর সেখানে যেন প্রচুর শস্য, ফলমূল শাক-সবজি উৎপন্ন হয়।’
সঙ্গে সঙ্গে আকাশে দেখা গেল নানা জাতের ও আকারের হরেক
হরেক রঙের অজস্র পাখি। তারা তাদের ঠোঁটে করে, নখে করে, তাদের ডানার নিচে বুকের কাছে
আঁকড়ে ধরে বহু পাথর, শিলাখণ্ড, বালিকণা ইত্যাদি নিয়ে এসে যেখানে ভূমিধস নেমেছিল সেখানে
একটা বিরাট বাঁধ তৈরি করে দিল। আর পশুদের ক্ষেত্রে নেতার ভূমিকায় দেখা গেল শিয়াল মহাশয়কে,
সে ই ছিল সবচাইতে বুদ্ধিমান ও কুশলী। সে তার অনুচরদের নিয়ে হ্রদের অপর প্রান্ত থেকে
পাহাড়ের মধ্য দিয়ে একটা খাল খনন করতে শুরু করলো, যেখান দিয়ে রাজপুত্র পারিয়াকাকার আকাঙ্খিত
জায়গায় এসে পর্যাপ্ত পানির ধারা পড়বে।
পৃষ্ঠা ২/ ৩
প্রকৌশলী শিয়ালের কাজ যখন প্রায় শেষ হয়ে এসছে ঠিক
তখনই কোথা থেকে আকাশে উড়ন্ত এক তিতির পাখি শিয়ালের নাকের কাছে নেমে এসে ’পি! পি!’ করে ডাক দিল, আর শিয়াল তৎক্ষণাত
তার দ্বায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা ভুলে গিয়ে ওই তিতিরের পেছন পেছন ছুটলো।
শিয়ালের অবর্তমানে সাপকে দ্বায়িত্ব দেয়া হয় এবং খাল
খননের কাজ আবার চলতে থাকে। তবে এই নতুন নেতা শিয়ালের মতো অতটা চালাক ও দক্ষ ছিল না।
কিছু কিছু অনাকাঙ্খিত পথে প্রবাহিত হয়ে বেশ খানিকটা জলের অপচয় ঘটে। তবুও কুমারীকন্যার
ক্ষেতের জন্য পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা করা হয় এবং তার জমি ও খামার সবচাইতে উর্বর, সবচাইতে
সম্পদশালী এবং সবার চাইতে ফলপ্রসূ হয়ে ওঠে।
এরপর একদিন রাজপুত্র পারিয়াকাকা কুমারীকন্যার সামনে
এসে হাজির হলেন। তখনও তিনি বৃদ্ধের ছদ্মবেশ ধারণ করে আছেন। কিন্তু কুমারীকন্যা তার
প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ওই বৃদ্ধকে বিয়ে করতে রাজি হল।
রাজপুত্র আনন্দোজ্জ্বল গলায় বলে উঠলেন, ‘এতদিনে আমি আমার উপযুক্ত সাথী পেলাম
যিনি আমাদের রাজবংশের প্রকৃত রক্ষাকর্ত্রী হবেন।’ এই বলে তিনি একটানে তার ছদ্মবেশ খুলে ফেললেন।
অবাক নয়নে কুমারীকন্যা দেখল কোন বৃদ্ধ নয়, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবক, যে কিনা সমগ্র ইনকাভূমির সর্বশ্রেষ্ঠ রাজপুত্র। আর রাজপুত্রের মুখেও তখন হাসির রেখা ফুটে উঠল।
***** সমাপ্ত *****
পূর্বের পোষ্ট: ইয়ারার গল্প (ব্রাজিলের লোককাহিনী) || লোককাহিনী - ১০
পরের পোষ্ট: হাতির চেয়ে চড়ুই কেন শক্তিশালী (আফ্রিকার লোককাহিনী) || লোককাহিনী - ১২
‘লোককাহিনী’ ক্যাটাগরির জনপ্রিয় গল্পসমূহ
◉ ভাগ্যবানের ভাগ্য (ভারতের লোককাহিনী)
◉ চুলার উপর টাকা (আফগানিস্তানের লোককাহিনী)
◉ একটা ব্যাঙের গল্প (তিব্বতের লোককাহিনী)
◉ ইয়ারার গল্প (ব্রাজিলের লোককাহিনী)