সারমর্ম: ঢাকা শহরে একটি পারমাণবিক বোমা ফেললে শহরটি ধ্বংস হতে কত সময় লাগবে, কতটুকু ধ্বংস হবে এবং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যা যা ঘটবে। মোট-৩ পৃষ্ঠা
নিজ চোখে পারমাণবিক হামলা দেখার সুযোগ না হলেও বিভিন্ন
প্রত্যক্ষদর্শী এবং ভুক্তভোগীর বর্ণনায় এবং নানান সময়ে বিস্ফোরণ পরীক্ষার ফলাফল থেকে
পারমাণবিক বোমার ভয়াবহতা কেমন হতে পারে তা নিশ্চয়ই কিছুটা আন্দাজ করতে পারেন আপনি।
কিন্তু কতটা ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে পারে একটি পারমাণবিক বিস্ফোরণ এটি মূলত নির্ভর করছে
কোন শহরে বা কোন অঞ্চলে আক্রমণ করা হচ্ছে এবং কোন ধরণের পারমাণবিক বোমা সেখানে নিক্ষেপ
করা হচ্ছে তার উপর।
১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোসিমাতে আমেরিকা ‘লিটল বয়’ নামে যে পারমাণবিক বোমাটি ফেলেছিল সেই বোমাটির মত
একই আকারের আরেকটি বোমা যদি ঢাকার জিরো পয়েন্টে ফেলা হয় তাহলে কি হবে? কতটুকু এলাকাজুড়ে
বিস্ফোরিত হবে সেই বোমাটি? এর ভয়াবহতা কিংবা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণই বা কেমন হবে? পরবর্তী
কত বছর সময় লাগবে সব ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করে ঢাকাকে আবার আগের রূপে ফিরিয়ে আনতে? জানতে
চান, তাহলে লেখাটি অবশ্যই শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।
তিনটি ধাপে একটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণের প্রকৃয়া
বর্ণনা করা যায়। এ প্রকৃয়াগুলো নিয়েই পরবর্তী অংশে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে যাতে একটি
বিস্ফোরণস্থলে আপনি উপস্থিত থাকলে ঠিক কি অনুভব করতেন তাই আপনি বুঝতে পারবেন। আলোচনার
সুবিধার জন্য আমরা জাপানের হিরোসিমায় ফেলা ‘লিটল বয়’ কে উদাহরণ হিসেবে ধরে নেব। আর
কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হবে বা এর ভয়াবহতা কেমন হবে তা নির্ভর করবে শহরের উপাদানগুলোর
উপর। ঢাকার ক্ষেত্রে আমরা ধরে নিতে পারি বিপুল পরিমাণ শিল্প কারখানা, রাস্তায় অসংঙ্খ্য
যানবাহন, লক্ষ লক্ষ টন প্লাষ্টিক এবং শহরজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্যাস লাইন এগুলোই
যথেষ্ট একটি শহরকে ছাই করে দিতে।
এবার আসি মূল আলোচনায়। তিনটি ধাপে আমরা জানবো একটি
পারমাণবিক বিস্ফোরণের রূপ কেমন হতে পারে।
প্রথম ধাপ: একটি শান্ত শহরে মানুষজন চলাফেরা
করছে। ঢাকার কথা ধরে নিলে প্রতিদিনের ব্যস্ততা চোখে পড়ছে, যে যার কর্মস্থলে যাচ্ছে,
বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে এমন সময় একটি পারমাণবিক বোমা এসে শহরের বুকে আঁচড়ে পড়ল। এরপর
যা হবে তার জন্য এক সেকেন্ডেরও কম সময় লাগবে। ১৮০ মিটার ব্যাসার্ধবিশিষ্ট আগুনের একটি
বলয় তৈরি হবে। এ বলয়ের মধ্যে যা যা থাকবে তা সব বাষ্প হয়ে উড়ে যাবে যেন আলোর এক সুনামি
এসে সবকিছু গ্রাস করে নিচ্ছে।
পৃষ্ঠা ১/ ৩
এ বলয়ের সামনে কোনকিছুই বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।
প্রচুর উত্তপ্ত একটি পাতিলের মধ্যে পানির একটি ফোঁটা ছেড়ে দেয়ার মতো হবে এ ব্যাপারটি।
মূহুর্তেই বাষ্প হয়ে উড়ে যাবে। সেই একই সেকেন্ডে ১ দশমিক ৭ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে
যা আছে সবকিছুই ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যাবে। কংক্রীটের দেয়ালও এর সামনে কিছুই নয়।
যে কোন ভয়াবহ প্রাকৃতিক দূর্যোগ ঠিকভাবে মোকাবিলা
করার মত প্রযুক্তি হয়তো মানুষ আবিষ্কার করতে পেরেছে। কিন্তু মনুষ্যসৃষ্ট এই দূর্যোগের
সামনে সেইসব প্রযুক্তি কোন কাজেই আসবে না।
আগুনের বলয় তৈরির ঠিক পরের সেকেন্ডেই ২ কিলোমিটার
ব্যাসার্ধের সবকিছুতেই আগুন লেগে যাবে যেন এইমাত্র একটি আলোর ঝলকানি দেখলেন আর ঠিক
পরের সেকেন্ডেই দেখলেন আপনার সামনে আগুন লেগে গেছে।
শুধু আপনি একা না আপনার আশেপাশে যা কিছু সবকিছুই আগুনে
পুড়তে পারে। সবকিছুতেই আগুন লেগে যাবে। গাছপালা, বাড়িঘর, বৈদ্যুতিক খুঁটি সবকিছুতেই
আগুন। আরো খারাপ অবস্থা হবে যখন গ্যাসের সিলিন্ডারগুলো একটি একটি করে ফাঁটতে শুরু করবে।
প্রায় ৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে পারমাণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে যাবে। এগুলো
কেবলমাত্র বোমা আঘাত হানার প্রথম দুই সেকেন্ডের কথা। ধীরে ধীরে অবস্থা আরও ভয়াবহতার
দিকে এগুবো।
দ্বিতীয় ধাপ: বোমা বিস্ফোরণের কেন্দ্রস্থল থেকে
প্রায় সাড়ে ৪ কিলোমিটার দূর থেকে আপনি দেখতে পাবেন কোথায় যেন ভয়াবহ আগুন লেগেছে।
বিশাল শোরগোল শোনা যাচ্ছে। দেখবেন ধীরে ধীরে মাশরুম
আকৃতি নিয়ে ধোঁয়া উড়ছে আকাশের দিকে। ততক্ষণে প্রায় ৩০ সেকেন্ড পার হয়ে গিয়েছে। মাশরুম
আকৃতির উচ্চতা খুব কম করে হলেও ২০ হাজার ফুট হবেই। আর প্রায় ২ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ
ধরে মাশরুমটির আকার ছড়িয়ে গিয়েছে।
আপনি যদি জানালায় দাঁড়িয়ে এসব দেখতে থাকেন তাহলে কিন্তু
বিশাল ভুল করবেন। কারণ প্রথম কয়েক সেকেন্ডেই এই ধ্বংসলীলা শেষ হয়ে যায়নি। মাশরুমটি
থেকে শকওয়েভ ধেয়ে আসছে ঠিক আপনারই দিকে। শকওয়েভটির মাত্রা কেমন হবে জানেন, সেটি আপনার
জানালার কাচ ভেঙ্গে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
কংক্রীটের পেছনে থাকলে হয়তো বেঁচে যাবেন কিন্তু ওই
শকওয়েভ দিয়ে আপনাকে শূন্যে ভাসিয়ে দেয়া খুব একটা কষ্ট হবে না।
ধীরে ধীরে দেখবেন ৫ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ জুড়ে কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে আছে। সেই সাথে তেজস্ক্রিয়তাও ছড়িয়ে পড়ছে শহর জুড়ে। একটু পরেই শুরু হবে তেজস্ক্রিয় কালো বৃষ্টি। বিষাক্ত বাতাসে চারপাশ ছেয়ে যাবে। আর এই সবকিছুই হবে বোমা বিস্ফোরণের প্রথম কয়েক মিনিটের মধ্যেই। এখানেই আপনার প্রাথমিক আঘাত শেষ হয়ে যাবে। পরবর্তী ধাপে ক্রামান্বয়ে আপনি বুঝতে পারবেন এই অল্প কয়েক মিনিটের আঘাতে কত বড় দূর্যোগের সামনে আপনি পরে গিয়েছেন।
পৃষ্ঠা ২/ ৩
তৃতীয় এবং
শেষধাপ:
পুরো শহর কালো অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। তেজস্ক্রিয় কালো বৃষ্টিতে পুরো বাতাস বিষাক্ত হয়ে
উঠেছে। আশেপাশের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট সব ভেঙ্গে গেছে। সব ধরণের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ।
বিশুদ্ধ পানির কোন সন্ধান নেই। যারা বেঁচে আছেন তাদের অধিকাংশই ধ্বংসস্তুপে চাপা পড়ে
আছেন। আশেপাশ থেকে যে সাহায্য আসবে সেই অবস্থাও আর নেই।
প্রাকৃতিক দূর্যোগের বেলায় একসাথে একটির বেশি দূর্যোগ
সাধারণত আসে না। কিন্তু এখানে ভূমিকম্প, অতিবৃষ্টি, দাবানল এবং পারমাণবিক দূর্ঘটনা
সব একসাথে ঘটেছে। তাই অন্য শহর বা দূর থেকে সাহায্য আসতে গেলেও বেশ সময় লাগবে। রাস্তাঘাট,
রেললাইন, বিমানের রানওয়ে সবকিছু যখন ধ্বংস হয়ে গিয়েছে তখন যোগাযোগ করার মত তেমন কোন
রাস্তাই নেই। আর যোগাযোগ ব্যবস্থা ছাড়া বর্তমান সভ্যতা কাজও করতে পারে না।
তাই আকাশপথে হেলিকপ্টার ছাড়া সাহায্য আসার আর কোন
উপায় নেই। দূরবর্তী শহরগুলোর দিকে তখন তাকিয়ে থাকতে হবে সাহায্যের আশায়। কিন্তু আকাশপথে
যারা সাহায্য নিয়ে আসবে তারাও তেজস্ক্রিয় পরিবেশে কাজ করার জন্য প্রশিক্ষিত নয়। সেক্ষেত্রে
খুব সহজে তারাও এই পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফল ভোগ করতে থাকবে।
ধরে নিলাম, কোন না কোনভাবে আপনি উদ্ধার হলেন, কিন্তু
এখানেও আছে বিপত্তি। আশেপাশের এলাকার সব হাসপাতাল এই বিপুল বিপর্যয় সামলানোর জন্য প্রস্তুত
নয়। আপনাকে যে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেবে সেটিও সম্ভব নয়। কারণ আপনি এখন ক্যান্সার
বহনকারীদের একজন। বাংলাদেশে উন্নত চিকিৎসা হয় এমন বেশিরভাগ হাসপাতালই রয়েছে ঢাকায়।
যেগুলোর প্রায় সবকয়টিই ততক্ষণে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়ে গিয়েছে।
আপনি একা নন। পুরো আক্রান্ত এলাকা জুড়েই তেজস্ক্রিয়তার
জন্য ক্যান্সার ছড়িয়ে গিয়েছে। আর আপনার আবাস এলাকাতেও ফেরত যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ সামনের
দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে সেটি পরিত্যাক্ত অঞ্চল হিসেবে পরে থাকবে। সরকারি অফিস আদালতও যেহেতু
একই সাথে বিলীন হয়ে যাবে তাই পুরো জাতি একপ্রকার নেতৃত্বহীন হয়ে পড়বে।
পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহতা এতই বেশি যে এর থেকে পরিত্রাণের
একমাত্র উপায় হল এর উৎপাদন বন্ধ করে দেয়া। হিরোসিমা এবং নাগাসাকিতে যে নিউক্লিয়ার বোম
নিক্ষেপ করা হয়েছিল তার থেকে সৃষ্ট ধ্বংসস্তুপ পরিষ্কার করতে জাপান সরকারের প্রায় দুই
বছর লেগেছিল এবং পরিবেশের ক্ষতিকর প্রভাব বিস্ফোরণের এত বছর পরেও ভোগ করছে স্থানীয়
অধিবাসীরা।
সুতারাং এর থেকে খুব সহজেই ধারণা করা যায় এইরকম একটি পারমাণবিক বিস্ফোরণ যদি কোন কারণে ঢাকা শহরে হয় তাহলে তার ক্ষতি বাঙ্গালি জাতি পরবর্তী কয়েক বছরেও পুরণ করতে পারবে কিনা সন্দেহ রয়েছে।
***** সমাপ্ত *****