সারমর্ম: পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে শরীরে কি কি সমস্যা দেখা দিতে পারে এবং আরও থাকছে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ার কিছু টিপস। মোট-৩ পৃষ্ঠা
আমাদের অনেকেরই ঘুমের সমস্যা আছে কিন্তু আমরা জানিনা যে ঘুমের অভাবে কি কি রোগ হতে পারে। এই লেখায় আজকে আমরা সেই বিষয়টা নিয়েই আলোচনা করবো এবং তার সাথে সাথে জানব যে ঠিক কি কি পদ্ধতি অনুসরণ করলে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়া যায়।
পর্যাপ্ত ঘুম না হলে যে সমস্যাগুলো হতে পারে-
প্রথমত, বলতে হবে ব্রেইন এর বিষয়ে। আপনারা হয়তো অনেকেই খেয়াল করে থাকবেন যে একরাত ভালোমত ঘুম না হলে পরের দিন ব্রেইন আর ভালোমত কাজ করে না। অনেকের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটা একটু হালকা হয় অনেকের ক্ষেত্রে আবার খুব বেশি হয়। এটার অনেকগুলো কারন থাকতে পারে। তারমধ্যে যে কারনটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হচ্ছে BDNF এর কার্যকারিতা। BDNF অর্থ হচ্ছে Brain-derived neurotrophic factor অর্থাৎ মস্তিষ্ক থেকে প্রাপ্ত নিউরোট্রফিক ফ্যাক্টর। আমাদের ব্রেইনে BDNF এর অনেকগুলো কাজ আছে। আমাদের ব্রেইনে যে কোষ আছে এগুলোর জন্মানো, বৃদ্ধি, একটি কোষের সাথে আরেকটির সম্পর্ক স্থাপন বা নিউরোট্রান্সমিশন করার কাজগুলো হওয়ার ক্ষেত্রে BDNF এর একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। এগুলো ছাড়াও আমরা যখন নতুন কোনকিছু শিখি এবং শেখার পরে সেই জিনিসটি মনে রাখার যে ক্ষমতা এই সবকিছুতেই BDNF এর একটা বিরাট প্রভাব রয়েছে।
আমরা যখন ঘুমাই তখন আমাদের মস্তিষ্কে BDNF এর উত্থান ঘটে। আমরা যদি ভালমত ঘুমাতে না পারি তখন BDNF এর extracellular availability কমে যাবে এর মানে হচ্ছে মস্তিষ্কের ব্যবহারের জন্য যতখানি BDNF প্রয়োজন হবে ততখানি থাকবে না। এর ফলে BDNF যে কাজগুলোতে সাহায্য করতো যেমন মস্তিষ্কে নতুন কোষের জন্মানো, সেগুলোর বৃদ্ধি ইত্যাদি কাজগুলো ভালমত হবে না।
দ্বিতীয়ত, হচ্ছে প্রজনন ক্ষমতা। এটির উপর অনেক গবেষণা করা হয়েছে। যেমন- একটি গবেষণায় বড় ইঁদুরদেরকে ঘুমাতে দেওয়া হয় না, মানে এই ঘুমের অভাবে তাদের প্রজনন ক্ষমতায় কি প্রভাব পরে সেটি দেখার জন্য এই কাজ করা হয় এবং পরবর্তীতে দেখা যায়, এই ঘুমের অভাবে তাদের শুক্রাণুর কার্যকারিতা কমে গেছে। অপর একটি গবেষণা করা হয় ছোট ইঁদুরদের উপর। এদের ক্ষেত্রে দেখা যায় ঘুমের অভাবে এদের যৌন আচরণ পরিবর্তন হয়ে গেছে, তাদের টেস্টোস্টেরণ লেভেল কমে গেছে এবং এদের জীবিত শুক্রানুর পরিমাণও কমে গেছে।
মানুষের
উপরও বেশকিছু গবেষণা করা হয়। একটা গবেষণাতে কিছু মানুষকে টানা ৮ দিন ৫ ঘন্টার বেশি
সময় ঘুমাতে দেয়া হয় না। ৮ দিন পর দেখা গেল তাদের মধ্যে এই ডে-টাইম টেস্টোস্টেরণ লেভেল
মানে যেটাকে সেক্স হরমোন বলা হয় সেটি ১০ থেকে ১৫% কমে গেছে।
পৃষ্ঠা ১
তৃতীয়ত, হচ্ছে অবিসিট বা মোটা হয়ে যাওয়া। ঘুম যদি পর্যাপ্ত না হয় তাহলে যে সমস্ত হরমোন আমাদের বেশি বেশি ক্ষুধা লাগাতে সাহায্য করে সেই হরমোনগুলোর পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে বেশি খাওয়ার পরিনামে মোটা হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। এছাড়া পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে মেটাবলিক রেভুলেশনেও (বিপাকক্রিয়া) পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। যেমন কেউ একজন আগে যে পরিমাণ খাবার খেত এখনো ঠিক সে পরিমাণ খাবার খায় কিন্তু এখন মেটাবলিজম রেট বা বিপাকের হার ধীরগতিসম্পন্ন হওয়ার কারণে সমপরিমাণ খাবার খেয়েও তিনি আগের চেয়ে বেশি মোটা হয়ে যাবেন। আর এই মেটাবলিজম রেট ধীরগতিসম্পন্ন হবে পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে। সুতারাং পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে এই ঘটনাগুলো ঘটতে পারে।
চতুর্থত, হচ্ছে ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। এটি খুবই মজার একটা ব্যাপার। আমাদের মধ্যে দেখে থাকবেন কেউ কেউ খুব বেশি পরিমাণে অসুস্থ হয় আবার কেউ কেউ দেখা যায় যে বছরে ১ বার ২ বারের বেশি অসুস্থ হয় না বা হয়তো তার থেকেও কম অসুস্থ হয়। এটার কারণ হচ্ছে যে ব্যক্তির ইমিউন সিস্টেম বা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি শক্তিশালী তার রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা কম। কারণ ইমিউন সিস্টেম মানে হচ্ছে আমাদের শরীরের ভেতরের আর্মি সিস্টেম। আমরা যে সারাদিন বাহিরে হাটাচলা বা কাজ করি বা আমরা যদি ঘরের ভেতরেও অবস্থান করি তবুও বাতাস থেকে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া আমাদের শরীরে যেতে পারে। কিন্তু এই ব্যাকটেরিয়া আমাদের শরীরের ভেতরে প্রবেশ আমাদের জন্য ক্ষতিকর হবে কি না তা নির্ভর করবে আমাদের শরীরের ভেতরের ইমিউন সিস্টেমের উপর। যার ইমিউন সিস্টেম যতবেশি শক্তিশালী তার শরীর ততবেশি সুরক্ষিত থাকে বাহিরের এসব ব্যাকটেরিয়া থেকে।
ইমিউন সিস্টেমের অংশগুলোর মধ্যে এন্টিবডি, সাইটোকাইন, ইমিউন সেলস ইত্যাদি আরো যেগুলো রয়েছে এগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমাদের ঘুমের সময়েই তৈরি হয়। আমাদের যদি ঘুমের অভাব হয় তাহলে এই ইমিউন সিস্টেম যথেষ্ট শক্তিশালী হবে না। এর ফলে আমাদের শরীরে হালকা ব্যাকটেরিয়াজনিক আক্রমণ যেমন ধরুন আমাদের নাক দিয়ে কোন একটা সাধারণ ব্যাকটেরিয়া আমাদের শরীরে প্রবেশ করল আর তাতেই আমরা অসুস্থ হয়ে যাবো, এমনটা হতে পারে।
এবার
চলুন আলোচনা করি কিভাবে দ্রুত ঘুমিয়ে পরা যায় এই সম্পর্কে
ঘুমের
কয়েকঘন্টা আগে থেকে উত্তেজনাকর সকল জিনিসপত্র বন্ধ করতে হবে। যেমন আমাদের শরীরে উত্তেজনা
আসতে পারে চা, কফি খাওয়া কিংবা ধূমপান করা থেকে অথবা কোন উত্তেজনাকর ভিডিও গেমস খেলা
থেকে, অথবা যে কোন গেম দেখা থেকে যেমন হতে পারে বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ক্রিকেট ম্যাচ থেকে।
খেয়াল করে থাকবেন উত্তেজনাকর মানুষিক অবস্থায় কেউই ভালভাবে ঘুমোতে পারে না। অনেকে তো
নির্মুম রাতও কাটিয়ে দেয়।
পৃষ্ঠা ২
দ্বিতীয়ত্ব, হচ্ছে দিনের বেলা না ঘুমানো যেন রাতের বেলা ঘুমের ক্ষেত্রে এটার প্রভাব না পরে। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় দিনের বেলা ঘুমালে রাতে আর ঘুম আসে না।
তৃতীয়ত, হচ্ছে আমাদের এটা চেষ্টা করা উচিৎ যে আমাদের ঘুমানোর জায়গাটার তাপমাত্রা স্বাভাবিক পরিবেশের চেয়ে যেন একটু কম থাকে।
চতুর্থত, হচ্ছে ঘুমানোর সময় ফোন, ল্যাপটপ ইত্যাদি ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসগুলো থেকে দূরে থাকা। কারণ এসব ডিভাইস থেকে অন্ধকারে নীল রশ্মি নির্গত হতে পারে যেটা আমাদের মেলাটনিন হরমোনের উৎপাদনকে ধীরগতির করতে পারে। এই মেলাটনিন হরমোন আমাদের ঘুম আসতে সাহায্য করে। তাই আমরা যারা ঘুমানোর পূর্বে ফোন ব্যবহার করি তারা অন্তত দুটো দিন ফোন ব্যবহার না করে বরং ঘুমানোর সময় ফোনকে আমাদের কাছ থেকে দূরে রেখে দেই এবং চেষ্টা করে দেখি যে দ্রুত ঘুম আসে কি না।
পঞ্চমত, হচ্ছে ঘড়ি থেকে দূরে থাকা মানে বারবার ঘড়ি চেক না করা। যখন আমরা ঘুমানোর চেষ্টা করি কিন্তু ঘুম আসছে না তখন দেখা যায় এরকম মনে হয় যে আচ্ছা অনেকক্ষণ ধরে ঘুমানো চেষ্টা করছি দেখি তো কটা বাজে আমি এখনো ঘুমাতে পারছি না কেন। তো সেই সময় আমাদের উচিৎ বার বার ঘড়ি চেক না করা।
ষষ্ঠ, হচ্ছে ঘুমানোর আগে ব্যায়াম করা। সারাদিন কাজ করে আমাদের শরীরের শক্তিকে খরচ করার পর যতটুকু শক্তি শরীরে অবশিষ্ট থাকে সেইটুকু শক্তি ব্যায়াম করে শেষ করে দেয়া যেতে পারে। এতে করে দেখা যাবে ঘুমানোর পূর্বে শরীরে তেমন কোন এনার্জি থাকবে না আর এজন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ঘুম এসে পড়বে। এজন্য আমাদের বাড়িতে ব্যায়াম করার ভারি ভারি জিনিসপত্র থাকতেই হবে এমনটা নয়, বরং ওগুলো না থাকলে আমরা অন্তত উঠাবসা করার ব্যায়ামটা করতে পারি। যেমনটা স্কুলে আমাদেরকে স্যারেরা কান ধরে উঠবস করাতো ঠিক সেভাবেই কান ধরা ব্যতীত উঠবস করা। এক্ষেত্রে প্রথমদিন ১৫টা করা যেতে পারে, দ্বিতীয়দিন ২০, এরপর ৫০, ১০০ এভাবে করা যেতে পারে।
আরেকটা ব্যাপার খেয়াল রাখতে হবে যে আমরা যখন ঘুমাতে যাই তখন আমরা চোখ বন্ধ করার সাথে সাথেই দুনিয়ার সমস্ত চিন্তা-ভাবনা আমাদের মাথায় এসে পড়ে। এই চিন্তা-ভাবনাগুলো করা যাবে না। কিন্তু এগুলোকে বন্ধ করার উপায় কি? এক্ষেত্রে একটা বিরক্তকর কাজ করা যেতে পারে। যেমন বিরক্তিকর কোন বই পড়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে দেখা যাবে কয়েকপৃষ্ঠা পরার পর ঘুম এসে পড়েছে। অথবা চোখ বন্ধ করে ১ থেকে ১০০০ পর্যন্ত গুনা যেতে পারে। এই সংখ্যা গণনা করারটা খুবই একটা বিরক্তিকর কাজ। কিন্তু দেখা যায় যে চোখ বন্ধ করে কয়েকটা সংখ্যা গণনা করার পরই অটোমেটিক ঘুম এসে পড়েছে।
পরিশেষে আমরা সবাই প্রতিদিন পর্যাপ্ত ঘুমানোর চেষ্টা করি এবং নিজেকে সুস্থ রাখি।
***** সমাপ্ত *****