এক
গ্রামে একজন ব্রাহ্মণ বাস করত। ব্রাহ্মণ ছিল
গরীব অথচ দয়ালু। ব্রাহ্মণের কুঁড়েঘর থেকে এক ক্রোশ দূরে ছিল রাজার বাড়ি। বুড়ো বয়সে
রাজা পিতা হয়েছে সেই সুবাদে মহারাজ রাজ্যের সমস্ত ব্রাহ্মণদের একদিন তার প্রাসাদে ভোজন
এবং উপহার সামগ্রী নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাল।
গরীব
ব্রাহ্মণ নির্দিষ্ট দিনে হাঁটতে হাঁটতে চলল রাজপ্রাসাদে। যেতে যেতে হঠাৎ দেখতে পেল
পথের ধারে পাঁকের ডোবায় একটা বাঘ আপ্রাণ চেষ্টা করছে ডোবা থেকে উঠে আসার জন্য, কিন্তু
ডোবার মধ্যে এত পাঁক যে কিছুতেই উঠতে পারছে না। ব্রাহ্মণকে ঐ রাস্তা ধরে আসতে দেখে
বাঘ বিনীত কন্ঠে বলল— হে ব্রাহ্মণ,
আমি ভীষণ সংকটে পড়েছি। অনুগ্রহ করে এই পাঁকের ডোবা থেকে আমাকে উদ্ধার কর।
ব্রাহ্মণ
বাঘের কথা শুনে বলল— তোমার জন্য
আমার খুব দুঃখ হচ্ছে কিন্তু তোমাকে আমি উদ্ধার করতে পারবো না বাপু! কারণ তোমাকে দয়া
দেখাতে গেলে তুমি আমায় শেষ করে দিবে।
বাঘ
তখন অশ্রুসজল কন্ঠে বলল— আমরা জন্তু
হতে পারি, কিন্তু আমাদের মধ্যেও দয়া মায়া আছে, যে ব্যক্তি আমাদের উপকার করে তাকে আমরা
চিরকাল আগলে রাখি।
বাঘের
মুখে এ হেন কথা শুনে ব্রাহ্মণের মনে দয়া হল। সে ভাবল মানুষের মধ্যে যেমন ভালমন্দ আছে,
তেমনি নিশ্চয়ই জন্তু জানোয়ারদের মধ্যেও আছে। অবশেষে ব্রাহ্মণ পাঁকের ডোবা থেকে বাঘকে
উদ্ধার করে নিয়ে এল।
পাড়ে
উঠে বাঘ জিজ্ঞাসা করল— ব্রাহ্মণ তুমি
কোথায় যাচ্ছ?
ব্রাহ্মণ
বলল— মহারাজের বাড়িতে ভোজনের নেমন্তন্ন আছে, সেখানে যাচ্ছি।
ব্রাহ্মণের
কথা শুনে বাঘ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। বাঘকে হাসতে দেখে ব্রাহ্মণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল— তুমি হাসছ কেন?
বাঘ
এবারে ক্রুর হাসি হেসে বলল— মহারাজের বাড়িতে
তোমার ভোজনের আগে আমি তোমাকে ভোজন করব।
বাঘের
কথা শুনে ব্রাহ্মণ ঘাবড়ে গেল। বলল—
সে কি কথা! তুমি এত বড় অধর্ম করবে? আমি তোমার প্রাণদাতা, আর আমাকেই তুমি খাবে?
বাঘ
ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলল— দেখ ব্রাহ্মণ
আমাকে ধর্ম-অধর্ম শেখাতে এসো না। আমি তোমাকে খাবোই খাবো।
ব্রাহ্মণ
তখন নতজানু হয়ে বাঘকে বলল— দেখ তুমি এত
বড় অন্যায় করো না আমার সাথে, প্রয়োজনে আরো তিন জনকে জিজ্ঞাসা করে দেখ, দেখবে ওরা কেউ
তোমাকে সমর্থন করবে না।
বাঘ
বলল— এই জনশূন্য পথে তুমি কাকে জিজ্ঞাসা করবে? কে বিচার করবে কোনটা ন্যায়
আর কোনটা অন্যায়?
গরীব
ব্রাহ্মণ কাতর কন্ঠে বলল— তুমি এই নদীর
ধার ধরে আমার সাথে চল, পথে যাকে দেখতে পাব তাকেই জিজ্ঞাসা করব।
বাঘ
বলল— ঠিক আছে ব্রাহ্মণ, আমি তোমাকে একবার সুযোগ দিচ্ছি। এই বলে বাঘ ব্রাহ্মণের
সাথে চলতে লাগল। যেতে যেতে হঠাৎ একটা বটগাছের সামনে ব্রাহ্মণ দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর বাঘকে
বলল— এই বটগাছটাকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিই- কোনটা ন্যায় আর কোনটা অন্যায়।
পৃষ্ঠা ১
ব্রাহ্মণ
বটগাছের সামনে গিয়ে বলল— আচ্ছা, আমি
ঐ বাঘটাকে উদ্ধার করেছি, এখন সে বলে কিনা আমাকে খাবে, এটা কি যুক্তিযুক্ত হল?
বটগাছ
বলল— বাঘ তো ঠিকই বলেছে।
ব্রাহ্মণ
বটগাছেরে কথা শুনে চোখ কপালে তুলে বলল—
সে কি! তুমিও অধর্মের কথা বলছো?
বটবৃক্ষ
তখন বলল— ধর্ম অধর্ম জানি না, আমি শুধু জানি কেউ কারো উপকার করলে বিনিময়ে
সে ক্ষতির সম্মুখিন হয়। এই দেখ না আমার বেলায়, আমি সারাদিন পথশ্রমে ক্লান্ত পথিককে
শীতল ছায়া দিই অথচ তারা বিশ্রাম করে চলে যাওয়ার সময় আমার ডাল থেকে পাত ছিঁড়ে নেয়। কেউ
কেউ আবার ডাল উপড়েও দেয়।
বাঘ
বলল— শুনলে তো ব্রাহ্মণ বটগাছের কথা, আমি আর বাপু দেরী করতে পারছি না খুব ক্ষুধা
লেগেছে।
ব্রাহ্মণ
বলল— দাঁড়াও, আরো দুজনকে জিজ্ঞাসা করা বাকি আছে। এই বলে ব্রাহ্মণ আবার
চলতে লাগল। ব্রাহ্মণকে অনুসরণ করে বাঘও চলতে লাগল। যেতে যেতে তারা দেখতে পেল নদীর স্রোতে
একটা মাটির হাঁড়ি ভেসে চলেছে। তখন ব্রাহ্মণ মাটির হাঁড়িকে বলল— আচ্ছা বাপু তুমিই বল, আমি এই বাঘকে পাঁক থেকে উদ্ধার করেছি, এখন
কিনা সে আমাকেই খেতে চায়, এটা কি ঠিক?
মাটির
হাঁড়ি বলল— আর আমি কি বলব।
তুমি বাঘকে পাঁক থেকে উদ্ধার করেছো ঠিকই তাই বলে যে বাঘ তোমাকে খাবে না তা তুমি ভাবলে
কি করে? আমিও তো কত লোকের উপকার করি, কিন্তু তার পরিবর্তে আমি কি পাই? ভাত রান্না থেকে
শুরু করে নোংরা পঁচা জিনিস আমার ভেতরে রাখতেও তারা কুণ্ঠা বোধ করে না, আর শেষ পরিণতি
পথের ধারে জঞ্জালে পড়ে থাকা অথবা জলে ভাসিয়ে দেওয়া। তাই উপকার করলেই যে কৃতজ্ঞতা স্বীকার
করতে হবে, সে কথা শুধু শাস্ত্রেই লেখা আছে।
বাঘ
মাটির হাঁড়ির কথা শুনে হাসতে হাসতে বলল—
কি বুঝলে ব্রাহ্মণ, দেখেছো! তোমার নীতি কেউ মানছে না। খামোখা দেরী করে লাভ কি, এবার
তোমাকে খাব।
ব্রাহ্মণ
বাঘের কথা শুনে ভয়ে শিহরে উঠল। সে বলল—
আরো একজনকে জিজ্ঞাসা করার বাকি আছে, আগে তার মতামত নিই তারপর তুমি আমাকে খাও, আমার
আপত্তি নেই। এই বলে, আবার চলতে লাগল, যেতে যেতে এবার দেখা হল এক শেয়ালের সাথে। শেয়াল
বাবাজী বাঘ দেখেই লেজগুটিয়ে পালাচ্ছিল, ব্রাহ্মণ চিৎকার করে ডেকে বলল— ও শেয়াল ভাই একটা কথা শুনে যাও।
ব্রাহ্মণের
ডাকে শেয়াল বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে বলল—
কি কথা? ব্রাহ্মণ তখন শেয়ালকে পুরো ঘটনার পুনরাবৃত্তি করে বলল— এবার তুমিই বল শেয়াল ভাই বাঘ আমাকে খেতে চাইছে, তাতে কি অধর্ম হবে
না।
পৃষ্ঠা ২
শেয়াল
বলল— দেখ বাপু আমি কানে কম শুনি, যেখানে ঘটনাটা ঘটেছিল তা দেখলে আমার
মতমত জানাতে পারি।
বাঘ
বলল— বেশ, ভালই হবে চল ঐ পাঁকের কাছে। সবাই তখন আবার পাঁকের ডোবার পথে
চলতে লাগল।
ডোবার
সামনে এসে ব্রাহ্মণ বলল— শেয়াল ভাই
এখানেই ঘটনাটা ঘটেছিল।
শেয়াল
তখন বলল— দূর বাপু! আমি তো আগেই বলেছি আমি কানে কম শুনি, কি ঘটেছিল এবার
সেই ঘটনাটাই একবার দেখাও।
বাঘের
তখন ক্ষিদের জ্বালায় পেট চোঁ চোঁ করছিল। সে বিরক্ত হয়ে বলল―
বোবা শেয়াল কোথাকার চোখে ভালমত দেখতে পাও তো?
শেয়াল
মাথা নাড়িয়ে বলল― তা পাই।
তবে
দেখো এই বলে বাঘ পাঁকে নেমে বলল― আমি এখানে আটকে ছিলাম। শেয়াল ব্রাহ্মণকে লক্ষ করে বলল বাঘ কি এখানেই
আটকে ছিল?
ব্রাহ্মণ
বলল―
না আর একটু দূরে।
বাঘ
আরেকটু পিছিয়ে গিয়ে বলল― আচ্ছা বাবা, এই আমি এখানে আটকে গিয়েছিলাম। এখান থেকে ব্রাহ্মণ আমাকে
উদ্ধার করেছে।
শেয়াল
বাঘকে থামিয়ে দিয়ে বলল― কেন, তুমি নিজে উঠতে পারছিলে না?
বাঘ বলল― না।
চতুর শেয়াল বলল, তোমার কথা বিশ্বাস করি না। দেখি তুমি উঠতে পার কি না? বাঘ এবার সত্যি সত্যি উঠে আসার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। আবার সেই একই জায়গায় আটকে গেল। তখন চতুর শেয়াল ব্রাহ্মণকে বলল, দেখেছ ব্রাহ্মণ, এই হল ওর উপযুক্ত শাস্তি, যে উপকারীর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে চায় না উপরন্তু ক্ষতি করার চেষ্টা করে তাকে শাস্তি দিতে হয় বুদ্ধি সহকারে। যেমনটি আমি দিলাম। ব্রাহ্মণ খুশি হয়ে শেয়ালকে গদ গদ গলায় বলল ভাই তোমার এই উপকার আমি কোন দিন ভুলব না।
***** সমাপ্ত *****