সারমর্ম: গ্রামে এসেছে এক ভূত যে সবার মাথা ছিড়ে নিয়ে যায়। ভৌতিকতা, রহস্য, নির্মমতা এবং কঠিন প্রেম যন্ত্রনার এক হৃদয়বিদারক গল্প। মোট-৬ পৃষ্ঠা
রাত হলেই শ্যামপুর গ্রামে সুনসান নিরবতা নেমে আসে-
এই নিরবতার মাঝে থাকে শুধুই পাতার মর্মর আওয়াজ আর ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। একটানা সেই ডাকে
মোহনীয় হয়ে থাকে যেন পুরো শ্যামপুর গ্রাম। সুনসান নিরবতার এই গ্রামে আজও রাত নেমে এসেছে।
কিন্তু প্রতিদিনের মত চুপচাপ নেই কেউ। খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত যে কৃষক সেও এসে ভিড় করেছে কালনীর
শাখা নদী সুলিনার তীরে। ব্যাপার কিছুই না- সেখানে ভেসে উঠেছে এক মহিলার লাশ।
সবাই যে যার মত বলাবলি করছে, চিনতে চেষ্টা করছে লাশটাকে- কিন্তু কেউ চিনতে পারছেনা। কারন এই মহিলাকে কেউ খুন করে মাথাটা কেটে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। এখন চারদিকে লোক পাঠানো হয়েছে মাথার খোঁজে। মাথা খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত এই লাশ দাফন করার জন্য কেউ এগোচ্ছেনা।
এর মাঝেই কোন কোন উৎসুক জনতা গিয়ে দূর থেকে কাঠি দিয়ে লাশের হাত পা দেখার চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু কোন ফলাফল নেই। হাতে পায়ে কোন চিহ্ন নেই- যে লাশটাকে চেনা যায়। রাত যত বাড়তে থাকে- তত মানুষের সমাগমও বাড়তে থাকে। মাঝে ভিড়ের চাপ কমে গিয়েছিল।
কিন্তু হঠাৎ করে শোনা যায় শেখের বাড়ির সুলেখা কে পাওয়া যাচ্ছে না। ভাইয়ের সাথে ঝগড়া করে ঘর থেকে রেগে মেগে বের হয়ে গিয়েছিল সুলেখা। তারপর থেকে ওর কোন পাত্তা নাই। সৎ মাও সুলেখার কোন খোঁজ করে নাই। এখনও সুলেখার মায়ের কোন দেখা নাই। শুধু ওর বড় ভাই জমির শেখ এর কান্নাকাটি চলছে লাশটার পাশে। অনেকেই ওকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে- কিন্তু পারছেনা। বার বার আছাড় খেয়ে খেয়ে মরা কান্না জুড়ে দিয়েছে জামাল শেখ। ছোট বোনটাকে অনেক ভালবাসতো সে।
সকালে ঝগড়া হবার সময় বলেছিল- ‘যা- দূরে যাইয়া মর গা’ এখন সেই কথা শুনিয়ে বলতে বলতে চিৎকার করে কেঁদে উঠল ও। কিন্তু লাশের পরিচয় পাওয়া গেলনা। এর মাঝেই গ্রামের তিনজন মুরুব্বি এসে নিজেদের মাঝে বাহাস করতে লাগল।
কেউ এই লাশ দাফন করতে চায়- কেউবা আবার নিয়ে ফেলতে চায় সেই পানিতে- যেখান থেকে ভেসে এসেছে লাশ। কেউ কেউ জানাজা পড়ার জন্যই বসে থাকল। কিন্তু লাশের পরিচয় পাওয়া গেলনা।
এর মাঝেই একটা চিৎকার শুনে সবাই দৌড়ে গেল সেই চিৎকারের
উৎসের দিকে। সেখানে এক ১২-১৩ বছরের ছেলে মাটিতে হোঁচট খেয়ে উল্টে পড়ে আছে। চিৎকার করছে
ভয়ে। কারন সে যে জিনিসটার সাথে হোঁচট খেয়েছে সেটা আর কিছু না- সেই বেওয়ারিশ লাশের মাথা।
মাটিতে সামান্য গর্ত করে কেউ ঢুকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু মাটি আলগা হওয়াতে তাতে হোঁচট খেয়েছে
ছেলেটা।
পৃষ্ঠা ১/ ৬
এরপর পরই ওঠে কান্নাকাটির রোল। সুলেখার নাকের ফুল
দেখেই সবাই চিনে ফেলে এটা সুলেখার লাশ। সাথে সাথেই দুই তিনজন মিলে সেই লাশের মাথা নিয়ে
এসে লাশের পাশে রাখে। মরা কান্না জুড়ে দেয় জামাল শেখ আর তার আত্মীয় স্বজনরা।
গ্রামের মাতব্বরদের মাঝে কয়েকজন এই লাশের জানাজা করে
দাফন করতে চায়না। চার পাঁচজন তাদের সাথে কোরান-হাদিস নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। ওই গ্রামের
মসজিদের মওলানার সাথে তর্ক লেগে যায় করিম মওলা আর তার ছেলে রহমান মওলার।
শেষে কোন মিমাংসা করতে না পেরে সেই লাশ দুই তিনজন
মিলে কোনরকম জানাজা পড়ে দাফন করে। এর মাঝে গ্রামের হেডমাষ্টার সবুজ মিয়াও ছিল। সবুজ
মিয়া নিজের দায় থেকেই সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দিয়েছিল লাশের জানাযা পড়াতে। একারনে পরদিন
এক সালিশে সবুজ মিয়াকে দোষী সাব্যস্থ করা হয়।
দিন সাতেক সবার মুখে মুখে এই ঘটনা একের পর এক ডানা
মেলতে থাকে। কেউ কেউ বলা শুরু করে সবুজ মিয়া ও সুলেখার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল।
আর এরই রেশ ধরে কয়েকদিন পর আবার সালিস ডাকা হয়। যে মানুষগুলো লাশ দাফন ও জানাজা করতে
চায়নি তাদের রায়ে সবুজ মিয়া কে একঘরে করে রাখে সবাই।
আসলে তারা গ্রামের ক্ষমতাশালী পরিবারের সদস্য হওয়ায়
কেউ ওদের মুখে মুখে তর্ক করার সাহস পায় না। এদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ছিলেন করিম
মওলা ও তার দুই ছেলে রহমান মওলা ও রহিম মওলা- এদের মধ্যে আবার বড় ছেলে রহমান মওলা পরের
মাসে চেয়ারম্যান পদে ভোটে দাড়াচ্ছে আর সে খুবই প্রভাবশালী। তাই তার সাথে কেউ কথা কাটাকাটি
করতে চায়নি।
ফলস্বরূপ নিরীহ সবুজ মিয়াকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে সবাই।
কিন্তু সুলেখার ভাই জামাল শেখের বন্ধুত্ব ছিল সবুজ মিয়ার সাথে। তাই সবুজ মিয়াকে নিজের
ঘরে খাওয়াতে শুরু করে সে। এভাবে দেখতে দেখতে বেশকিছু দিন চলে যায়। সবকিছু প্রায় স্বাভাবিক
হয়ে আসে আর এর মাঝে সবাই সুলেখার কথা প্রায় ভুলেই যায়।
প্রায় ১ মাস পর হঠাৎ একদিন গ্রামের মসজিদের ইমাম ইসমাইল মিয়া ফজরের নামাজের আজান দিতে গিয়ে এক বীভৎস দৃশ্য দেখে ভয়ে চিৎকার করে মসজিদের দিকে ছুটতে ছুটতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে।
সকালে সবাই তাকে অজ্ঞান অবস্থায় মসজিদের কাছে খুঁজে পায়। কেউ বলতে পারছেনা কেন সে অজ্ঞান হয়েছে। অনেকক্ষন পর তার জ্ঞান ফিরলে সে সবাইকে নিয়ে যায় সুলেখার লাশ যেখানে দাফন করা হয়েছিল সেখানে।
সুলেখার লাশের পাশে একটা জারুল গাছ
আছে- সেখানে একটা ডালে পাওয়া যায় করিম মওলার ছিন্ন ভিন্ন লাশ। লাশের অবস্থা এতটাই বিভৎস
যে লাশটি দেখে পরিচয় সনাক্ত করার কোন উপায় নেই। কিন্তু গাছের গোড়ায় কে যেন লাশের মাথাটা
সযত্নে কেটে সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে।
পৃষ্ঠা ২/ ৬
দৃশ্যটা দেখে অনেকেই সহ্য করতে পারেনি। শেষে পুলিশকে
ডেকে পাঠানো হয়। পুলিশ এসে লাশ নিয়ে যায় ময়নাতদন্তের জন্য। এর মাঝে রহমান মওলা ক্ষেপে
যায় নিজের পিতার এই অবস্থা দেখে। বিকেল যেতে না যেতেই লোকজন নিয়ে সবুজ মিয়ার বাড়ি আগুনে
জ্বালিয়ে দেয় সে। সবাইকে বলে বেড়াতে থাকে যে সবুজ মিয়া গুণ্ডা লাগিয়ে তার বাবাকে হত্যা
করিয়েছে। এই সময় তার সাঙ্গ পাঙ্গরা মিলে সবুজ মিয়াকে গাছের সাথে বেঁধে ইচ্ছামত মারতে
থাকে। শেষে মার খেয়ে সবুজ মিয়া অজ্ঞান হয়ে গেলে ওকে নিয়ে স্কুল ঘরের একটা রুমে বেঁধে
রাখে।
এদিকে সবাই গোপনে সুলেখার ভূতের কথা বললেও রহমান মওলার
সামনে কেউ তর্ক করেনি মার খাবার ভয়ে। প্রায় দুইদিন ধরে সবুজ মিয়া সেই স্কুলে বন্দি
থাকে। সকাল বেলা এসে রহমান মিয়ার লোক খাবার দিয়ে যায়। সবুজ মিয়ার খাওয়া শেষ হওয়ার সাথে
সাথেই আবার মার শুরু হয়। শেষে অজ্ঞান হয়ে পড়লে তাকে দড়ি বেঁধে রেখে যায় রহমান মওলার
লোকজন।
এর মাত্র তিনদিন পরেই আবার শ্যামপুর গ্রামে শোরগোল উঠে। এবার ভোর সকালে পাওয়া যায় রহমান মওলার মাথা কাটা লাশ। মাথা কাটা লাশ গ্রামবাসি এর আগেও দুটো দেখেছে। কিন্তু এই রহমান মওলার লাশের কোমড় থেকে পায়ের দিকটায় কোন মাংস ছিল না। পাশেই পড়েছিল হাড়গোড়। দেখে মনে হচ্ছিল যেন পাশের জঙ্গল থেকে শেয়াদের দল এসে সব মাংসগুলো ছিড়ে ছিড়ে খেয়ে শুধু হাড়গোড় গুলো ফেলে গেছে।
রহমান মওলার লাশের কাটা মাথার
চোখদুটো বড় বড় হয়ে ভয়ার্তভাবে তাকিয়ে ছিল তখনও মনে হচ্ছিল যেন চোখদুটো তখনও ভয়ংকর কোন
জিনিসকে দেখছে। কাটা মাথাটায় প্রকাশ পাচ্ছিল শেষবারের মত বাঁচার তীব্র আকুতি।
এবারো পুলিশ এসে সবাইকে জেরা করতে শুরু করে এবং গ্রামের
বেশ কয়েকজন লোক পালিয়ে যায় ভয়ে। কিন্তু পুলিশকে রহমান এর ভাই রহিম মওলা টাকা খাইয়ে
বিদায় করে দেয়। গ্রামবাসি স্বস্তি পেলেও ভয়ে লোকজন দিনের বেলাও বাড়ি থেকে বের হওয়া
বন্ধ করে দেয়। সবুজ মিয়াকে নির্যাতন বন্ধ করা হয়- কিন্তু তাকে বন্দি করেই রাখা হয় সেই
স্কুল ঘরে।
এর প্রায় এক সপ্তাহ পরেই পরপর দুইজন লোকের লাশ পাওয়া যায় মাথাহীন অবস্থায়। এই দুই জন হল গ্রামের সেই দুই মুরুব্বি যারা সুলেখার লাশ দাফনে বাঁধা দিয়েছিল। যারা সুলেখার জানাজা পড়তে চায়নি। গ্রামবাসী এরপর প্রায় চুপচাপ হয়ে যায়। পুরো গ্রাম হয়ে পড়ে স্তব্ধ। মানুষজন একে অন্যের সাথে খুব প্রয়োজন ছাড়া একটি কথাও বলে না।
সেই রাতে যারা লাশের জানাযা না পড়াতে মুরুব্বিদের সাথে গলা মিলিয়েছিল তারা সহায়
সম্বল ফেলে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। এর মাঝে পুলিশ এসে দুইবার সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করে।
কিন্তু একটি খুনেরও কোন কূল-কিনারা উৎঘাটন করতে পারে না।
পৃষ্ঠা ৩/ ৬
ঘটনার প্রায় এক মাস অতিবাহিত হয়ে যায়। গ্রামের পরিবেশ আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। মওলা পরিবারে বাবা ও বড় ভাইয়ের গলাকাটা লাশ পাওয়ার পর ছোট ভাই রহিম মওলার উপরে পরিবারের সমস্ত দ্বায়িত্ব পড়েছে। অমাবশ্যার রাতে রহিম মওলা ঘরে তার খাটে শুয়ে আছে। বাপ ভাইয়ের উত্তরসুরি এখন সে। এই কয়দিনের মাঝে নিজের প্রতিপত্তি প্রকাশে এলাকাতে টহল দিতে শুরু করেছে সে। মোটর সাইকেল নিয়ে এলাকার চ্যাংড়া ছেলে পেলেদের সাথে ঘুরে ঘুরে নিজেকে বাপ ভাইয়ের যোগ্য উত্তরসুরি হিসেবে জানান দিচ্ছে।
আজ সারাদিন ঘোরাঘুরি করে অনেক বেশি ক্লান্ত ছিল রহিম মওলা। গ্রামের মকবুল বুড়ার একটা খাসি জবাই করে খেয়ে দেয়ে শান্তির একটা ঘুম দিয়েছে সে।
প্রতিদিনের চেয়ে এই অমাবস্যার রাত ছিল বেশি সুনসান।
রহিম মওলা গভীর ঘুমে। এমন সময় দরজায় টোকা পড়ে। গুনে গুনে তিনটা টোকার শব্দ হয়। আর তাতেই
রহিম মওলা জেগে উঠে। কিন্তু দরজা খুলে হতভম্ভ হয়ে পড়ে সে। দেখে তার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল
সাদা কাপড়ে মোড়ানো একটা লাশ, যেটির ডান হাত ছিল কাপড়ের বাহিরে আর হাতের আঙ্গুলগুলো
দিয়ে তখনও তাজা রক্ত ঝড়ছে। দেখেই ভয়ে হতভম্ভ হয়ে যায় রহিম। কিছু বুঝে উঠার আগেই সেই
লাশের ডান হাত তার মাথার উপরে উঠে আসে সাথে সাথে জ্ঞান হারায় রহিম মওলা।
জ্ঞান ফিরেই একটা কুয়াশাচ্ছন্ন এলাকায় নিজেকে আবিষ্কার
করে রহিম মওলা। চারদিকে ঘন কুয়াশার মাঝে ভয়ে কয়েকবার নিজের বন্ধুদের নাম ধরে ডাক দেয়
সে। কিন্তু কেউ তো সাড়া দেয়না। মনে করেছিল ওর সাঙ্গ পাংগদের কেউ ওর সাথে ফাজলামি করছে।
চিৎকার করে বিশ্রী গালাগালও দিল কিছু। কিন্তু এরপরই চারদিকে চারটা কাফনে জড়ানো লাশের
অস্তিত্ব অনুভব করে সে এবং একটু পরেই বুকের ভেতরে তীব্র চাপ অনুভব করে সে। মনে হচ্ছিল
যেন কেউ তাকে প্রচন্ড শক্ত করে চিপে ধরেছে। শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হয় রহিম মওলার।
ধীরে ধীরে কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশ কেটে গিয়ে চোখের সামনে
সবকিছু স্পষ্ট হতে থাকে। কিন্তু্ একি! সামনে তাকিয়ে তার চোখ স্থির হয়ে যায় ঠিক যেন
তার ভাইয়ের কাটা মাথার চোখগুলোর মতই। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রহিম, কারণ তার সামনে বসে
আছে সুলেখা। দেখেই ভয়ে চিৎকার করতে গিয়েও পারে না, মুখ দিয়ে কোন শব্দই বের হয় না।
এমন সময় সুলেখা বলে ওঠে- ‘কি রে, আমারে চিনতে পারসোস? আমি
সুলেখা- এই যে দেখ আমার মাথা এহনও কাডা’- বলেই নিজের মাথাটা দুই হাত দিয়ে
একটানে খুলে রহিম মওলার সামনে ধরলো। দেখেই বমি করে দিল রহিম মওলা। দুই হাত দিয়ে পেট
চেপে একপ্রস্ত বমি করে রহিম মওলা শুধু এতটুকুই বলল- ’আমাকে ছেড়ে দাও?’
পৃষ্ঠা ৪/ ৬
সুলেখা - ‘কি? ছাড়ি দিমু? সেদিন কি আমাক ছাড়িছিলি
রে তোরা দুই ভাই? আমি কতক করি কয়েছি আমাক ছাড়ি দে- তোরা আমার ছোট ভাই লাগস- নিজের বইন
মনে করি ছাড়ি দে- কই সেদিন তো ছাড়িস নাই। আমাক দুইজন মিলি নষ্ট করলি। তারপর আমাক যাতে
কেউ চিনতে না পারে- তুই আর তোর মওলার বাচ্চা আমার মাথা কাটি ফালালি। আমার সবুজ মিয়ারে
কতক মারলি তোরা- কই সেদিন মনে আছিল না? মনে আছিল না আমার কথা?’ বলেই নিজের মাথাটা আবার নিজের
গলায় জোড়া লাগালো সুলেখা।
এবার কেঁদেই ফেলল রহিম। বলল- ‘আফা ভুল হইয়ে গেছে আফা- তুমি আমারে
এবারের মত মাফ করি দেও আফা। আমি কইতাছি আমি এর পেরাচিত্ত করি ছাড়ুম।’
সুলেখা বলল- ‘তোরে পেরাচিত্ত করার লাইগাই তো
আমি আইছি।’ এটা বলে খিল খিল করে হেসে উঠল
সুলেখা। সেই হাসি স্বাভাবিক কোন মানুষের হাসি না। হাসিটি চারদিকে প্রতিধ্বনিত হয়ে রহিম
মওলার কানে তীব্র থেকে তীব্রতর হতে শুরু করলো। কাঁপতে শুরু করে দিল রহিম মওলা। আস্তে
আস্তে সামনে এগিয়ে আসছে সুলেখা। সামনে ভয়ার্ত রহিম মওলা। তারপর রহিমের কাছে এসে তার
চুলগুলো ধরে একটানে দেহ থেকে ছিড়ে ফেলল তার মাথাটা। গলগল করে তাজা রক্ত ঝরছিল সেই কাটা
মাথা থেকে। মওলা পরিবারের শেষ বাতিটাও নিভে গেল। মাথাটা হাতে নিয়ে গা হিম করা একটা
চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল সুলেখা।
এই ঘটনার কিছুক্ষন পর শেষ রাতের দিকে নিজের চোখে মুখে
জলের ঝাপটা খেয়ে জেগে উঠল সবুজ মিয়া। মাসখানেক ধরে এভাবেই তার ঘুম ভাঙ্গে। মওলাদের
কেউ একজন চোখে মুখে পানি ঢেলে দেয়। তারপর খাওয়া দেয়। তার কিছু খায়- কিছু খায়না। তারপর
খাওয়া শেষ হলেই শুরু হয় মার। আজকেও তাই জেগে ও চোখ বন্ধ করে রেখেছিল সে। কিন্তু মাথায়
একটা কোমল স্পর্শ পেয়ে চোখ মেলে দেখে তার পাশেই বসে আছে সুলেখা। আস্তে আস্তে উঠে বসল
সবুজ। শরীরে এতদিন না খাওয়ার ফলে শক্তি নাই। কিন্তু কেন যেন নিজের চোখকে খুব বিশ্বাস
করতে ইচ্ছা করছে তার। সে বলল- ‘সুলেখা তুমি?’
’হা আমি- মইরা গেছিলাম। আজকা আমার মুক্তি হইতাছে- তাই শেষবারের মতো তোমারে
দেখতে আইলাম’ বলেই কেঁদে ফেলল সুলেখা।
’আমার বিশ্বাস হইতেছে না রে- তুমি কেমনে মরলে রে?’ চোখ বড় বড় করে বলল সবুজ মিয়া।
’এত শুইনে কোন লাভ নাই মাষ্টার। তুমি আস্তে আস্তে ওঠো। নাও আমি তোমারে শেষ বারের মত খাওয়াই দিতাছি দুইটা ভাত’- বলে পাশে রাখা থালা থেকে ভাত খাইয়ে দিল সুলেখা সবুজ কে।
পৃষ্ঠা ৫/ ৬
সবুজ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনা। কোন কিছুর সাথে কোনকিছু
মেলাতে মেলাতে ক্লান্ত হয়ে শেষে ভাত খেতে শুরু করল মন্ত্রমুগ্ধের মত।
খাওয়া শেষে সুলেখা বলল- ’আমি যাই মাষ্টার- তুমি কয়দিন পর
সুন্দর দেইখে একটা নিকা কইরো। আমাকে ভুলি যাইও মাষ্টার’- বলেই পা বাড়াল সুলেখা।
এতক্ষন ঘোরের মাঝে থাকলেও এখন জ্ঞান ফিরে আসে সবুজ মিয়ার। দৌড় দেয় দরজার দিকে। দরজা খোলাই ছিল। বাইরে বেরিয়ে দেখে ভোর হয়ে গেছে। সূর্য প্রায় উঠে গেছে। আর সেই সূর্যের দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে চলেছে সুলেখা। কিন্তু সবুজ আর দৌড়ায়নি সুলেখার পেছন পেছন- কারণ সুলেখা এগিয়ে চলেছিল তার শেষ ঠিকানা সেই কবরের দিকে.....
***** সমাপ্ত *****