বাংলাদেশের সাথে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারি চাকুরিতে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থার পার্থক্য || সময়ের আলোচিত ঘটনাবলী ৩

 

সারমর্ম: বাংলাদেশের সরকারি চাকুরিতে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থা এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারি চাকুরিতে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থা ও যেভাবে সেগুলোর প্রয়োগ হয়। মোট- ৩ পৃষ্ঠা


সরকারী চাকুরীতে কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য সারাদেশব্যাপী চলছে আন্দোলন। কেন এই আন্দোলন? কি রয়েছে কোটা ব্যবস্থায়? বাংলাদেশ ছাড়াও আর অন্য কোন দেশে কি এ ব্যবস্থা রয়েছে?

সরকারী চাকুরিতে প্রচলিত বাংলাদেশের বর্তমান কোটা ব্যবস্থা

পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সমতার ভিত্তিতে এগিয়ে নিতে কর্মসংস্থানসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিতে সারাবিশ্বে কোটা সংরক্ষণ ব্যবস্থা প্রচলিত। বাংলাদেশেও মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে এ ব্যবস্থা শুরু হয়।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত ২০% পদে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ করা হত। বাকী ৮০% পদে কোটা নিয়োগ হত।

১৯৭৬ সালে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ ৪০% এ উন্নীত করা হয়।

১৯৮৫ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে ৪৫% মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের নিয়ম চালু করা হয়। বাকী ৫% অগ্রাধিকার কোটায় নিয়োগ দেওয়া হয়। এই অগ্রাধিকার কোটায় রয়েছে,

৩০% মুক্তিযোদ্ধা,

১০% নারী,

১০% জেলা ও

৫% ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী।

পরে ১% পদ প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের দিয়ে পূরণের নিয়ম চালু হয় এবং মোট কোটা হয় ৫৬%

১ম শ্রেণি ও ২য় শ্রেণির চাকুরিতে এই ৫৬ শতাংশ কোটা থাকলেও তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকুরিতে আরও যোগ হয়েছে আনসার ও প্রতিরক্ষা সদস্য কোটা, শিশু সনদের এতিমদের জন্যও রয়েছে আলাদা কোটা, আবার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক নিয়োগে রয়েছে ৫০ শতাংশ নারী কোটা। অনেকেই বলছেন এত সব কোটার কারণে প্রকৃত মেধাবীরা কম মূল্যায়িত হচ্ছে এবং অযোগ্য প্রার্থীরা চাকুরি পাচ্ছে।

শুরু থেকেই মুক্তিযোদ্ধা কোটা ছিল। পরে এ কোটায় মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং তারপর নাতি-নাতনি যুক্ত করা হয়। এক পরিবারের সব সদস্যই এসব কোটায় সুবিধা নিতে পারেন। শিক্ষা ও চাকুরি উভয়ক্ষেত্রে কোটা সুবিধা নেয়ার ক্ষেত্রেও কোন বাধা নেই।

 

এতো গেল বাংলাদেশের কোটা ব্যবস্থা। বিশ্বের আর কোন দেশে কি সরকারি চাকুরিতে কোটা ব্যবস্থা রয়েছে? থাকলেও কেমন সে ব্যবস্থা এবং কিভাবে সেগুলো প্রয়োগ করা হয়? চলুন তবে এবার তা জেনে নেয়া যাক।


ভারতের কোটা ব্যবস্থা:

ভারতে মোট ৪ ধরণের কোটা রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে

(১) উপজাতি কোটা ৭.৫ শতাংশ

(২) বিভিন্ন জাতভিত্তিক কোটা ১৫ শতাংশ

(৩) সংখ্যালঘু অন্যান্য অনগ্রসরের জন্য কোটা ২৭ শতাংশ

(৪) অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল তথা দরিদ্র কোটা ১০ শতাংশ

এই কোটা পদ্ধতি পুরো ভারতবর্ষের সরকারি চাকুরি ও উচ্চশিক্ষায় বিদ্যমান। তবে এখানে মোট ৫৯.৫ শতাংশ কোটা থাকলেও দেশটিতে কোটার জন্য রয়েছে একটি সুষ্ঠ ব্যবস্থা। একটি পরিবারের মাত্র একজনই কোটা সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে এবং যদি কেউ উচ্চশিক্ষার জন্য কোটা গ্রহণ করে তবে সে চাকুরিতে কোটা সুবিধা পাবে না।


পৃষ্ঠা ১


 

পাকিস্তানের কোটা ব্যবস্থা:

বিভিন্ন অঞ্চলের জনসংখ্যার উপর নির্ভর করে সে অনুপাতে কোটা সুবিধা প্রদান করা হয় পাকিস্তানে। দেশটিতে কোটা পদ্ধতির মুল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যৌক্তিক পরিমাণ মানুষ যেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। সরকারি চাকুরিতে সমগ্র দেশ থেকে মাত্র ৭.৫ শতাংশ চাকুরি মেধা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে হয়ে থাকে। বাকী ৯২.৫ শতাংশ চাকুরি বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য সংরক্ষিত।

পাকিস্তানের সরকারি চাকুরির অঞ্চলভিত্তিক কোটাসমুহের মধ্যে রয়েছে

          পাঞ্জাব প্রদেশের জন্য ৫০ শতাংশ

          সিন্ধ প্রদেশের জন্য ১৯ শতাংশ

          খাইবার-পাখতুনওয়ার প্রদেশের জন্য ১১.৫ শতাংশ

          বালুচিস্তানের প্রদেশের জন্য ৬ শতাংশ

          গিলগিট-বালিস্তান প্রদেশের জন্য ৪ শতাংশ

          আজাদ-কাশ্মীরের জন্য ২ শতাংশ কোটা বরাদ্ধ রয়েছে।

এছাড়া সরকারি চাকুরিতে পুরো আসন ব্যবস্থার উপরে ১০ শতাংশ আসন নারীদের জন্য বিশেষভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

 

নেপালে কোটা ব্যবস্থা:

নেপালে সরকারি চাকুরিতে বর্ণ, জাত এবং লিঙ্গের উপরে ভিত্তি করে কোটা ব্যবস্থা দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটি সাধারণ কোটা যা ৫৫ শতাংশ অন্যটি সংরক্ষিত কোটা যা ৪৫ শতাংশ। সংরক্ষিত কোটার মধ্যে নারী, উপজাতি, মাধেশি, দলিত সম্প্রদায়, প্রতিবন্ধী ও প্রত্যন্ত জনগোষ্ঠীর জন্য ১৯৯৩ সাল থেকে আলাদা আলাদা ভাগ করা হয়েছে।

 

মালয়েশিয়ার কোটা ব্যবস্থা:

মালয়েশিয়ার বর্তমান জনসংখ্যা ৩ কোটি ৩৯ লক্ষ ৪ হাজার। মোট জনসংখ্যার ৫০.১ শতাংশ মালয়, ২৬.৬ শতাংশ চাইনিজ, ৬.৭ শতাংশ ভারতীয়, ১১.৮ শতাংশ স্বদেশজাত এবং ৮.৮ শতাংশ অন্যান্য। মালয়েশিয়ায় উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে জাতিগত কোটার মোট ৫৫ শতাংশ সুবিধা পেয়ে থাকে মালয় জনগোষ্ঠী। উচ্চশিক্ষা, চাকুরি, সল্পমূল্যে বাসস্থানসহ সকলক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ ভোগ করে এই মালয় জনগোষ্ঠী। বাকী ৪০ শতাংশ সুবিধা ভোগ করে অন্যান্য জনগোষ্ঠী। তবে চাকুরির ক্ষেত্রে গোষ্ঠীগত সুবিধা মিললেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেধার পরিচয় দিয়েই প্রবেশ করতে হয়। সরকারি অর্থায়নে যে সকল বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয় সেখানে মোট সিটের ১৯ শতাংশ পায় চাইনিজরা এবং ৪ শতাংশ ভারতীয় বংশদুত জনগোষ্ঠী। বাকী সকল সিটই পায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মালয় জনগোষ্ঠী যারা ভূমিপুত্র নামেও পরিচিত।


জাপানে কোটা ব্যবস্থা:

জাপানে বুড়াকুমিন এবং কোরিয়ান সম্প্রদায়কে সরকারি চাকুরিতে বিশেষভাবে প্রাধান্য প্রদান করা হয়। এছাড়া ব্যক্তিমালিকানাধীন কিংবা বেসরকারি কোন পণ্য এবং সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মীসংখ্যা ৫ শতাধিক হলে বুড়াকুমিন এনং আদিবাসি সম্প্রদায়ের জন্য ৫ শতাংশ কোটার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। শুধু চাকুরির ক্ষেত্রে নয় অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য জাপানে কম মুনাফায় ব্যাংক লোন, শুল্ক অব্যহতি এমনকি বিদ্যালয় ও কলেজে বিনা বেতনে লেখাপড়ার সুযোগও রাখা হয়েছে।


পৃষ্ঠা ২


 

 

চীনের কোটা ব্যবস্থা:

চীনের মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ বিভিন্ন জাতি ও আদিবাসি সম্প্রদায়। এই জনগোষ্ঠীর জন্য চীন সরকার স্বীকৃতভাবে সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রে অন্যদের তুলনায় অপেক্ষকৃত কম যোগ্যতার বিধান রেখেছে। চীনে নারীদের জন্য একসময় ২০ শতাংশ কোটা ছিল তবে গত শতাব্দীর ৯০ এর দশকে ঐ কোটা প্রত্যাহার করে নেয়া হয় আর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য দেশটিতে চাকুরির ক্ষেত্রে এখনও ১.৫ শতাংশ আসন সংরক্ষণ করা হয়।


কানাডার কোটা ব্যবস্থা:

উন্নত রাষ্ট্র কানাডায় চাকুরিতে কোটা ব্যবস্থার প্রয়োগ হয় প্রকৃত পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য। কানাডায় বিভিন্ন সরকারি চাকুরি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার ক্ষেত্রে মূলত ৪টি শ্রেণির জন্য কোটা প্রযোজ্য, এদের মধ্যে রয়েছে নারী, প্রতিবন্ধী, আদিবাসী এবং সংখ্যালঘু। এই ৪টি শ্রেণির মোট কত শতাংশ কোটা নির্ধারণ করা হয়েছে সেটা সুস্পষ্টভাবে কানাডার এমপ্লয়মেন্ট ইক্যুইটি এক্ট এ নির্দিষ্টভাবে বলা না হলেও সেটা কখনই মেধার চেয়ে বেশি নয়।

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোটা ব্যবস্থা:

বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি চাকুরিতে শতকরা ৮ ভাগ আসন প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত থাকে। তবে চাকুরি, শিক্ষা বা অন্য কোন প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্রে যে কোন ধরণের বর্ণবৈষম্য একটি শাস্তিযোগ্য ফৌজদারী অপরাধ।

 

ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহের কোটা ব্যবস্থা:

ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত মোট ২৭টি দেশ আছে। এখানে বেশকিছু নিয়মকানুন ইউরোপীয় ইউনিয়ন একেবারেই নিজস্বভাবে তৈরি করে থাকে যা সব সদস্য দেশগুলোতেই বলবৎ হয়ে থাকে। এখানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে নারীদের প্রতি। নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো ২০১২ সালে এক পরিকল্পনা গ্রহণ করে যার মাধ্যমে ২০২০ সালের মধ্যে নন এক্সিকিউটিভ চাকুরিগুলোতে যেন ৪০ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। একটি প্রতিষ্ঠানের নন এক্সিকিউটিভ কর্মী বলতে তাদেরকেই বোঝায় যারা শুধুমাত্র কোম্পানির বিভিন্ন বিষয় সংক্রান্ত পরামর্শ দিতে পারে কিন্তু কোম্পানিতে কোন বিষয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা তাদের থাকে না। এছাড়াও ইউরোপীয় ইউনিয়নে শারীরিকভাবে যারা অক্ষম তাদের জন্য কোটা সংরক্ষণের হার শতকরা ৪ ভাগ।

 

বিভিন্ন দেশের কোটা ব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে একটি বিষয় সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে কোটা বরাদ্দের অনুপাতটি একটি চলমান প্রকৃয়া। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থার পরিপেক্ষিতে এই কোটা বরাদ্দ করা হয় বিধায় সময়ের সাথে সাথে ঐ জনগোষ্ঠীর অবস্থার উন্নতি হলে বিভিন্ন সময়ে এ ব্যবস্থার সংস্কার সাধন করা হয়েছে।

          

***** সমাপ্ত ***** 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post