সারমর্ম: স্বাধীন বাংলাদেশের টাকার ইতিহাস, বিবর্তন, বাংলাদেশের কোথায় কিভাবে টাকা ছাপানো হয় এবং বাংলাদেশের বর্তমান প্রচলিত আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থার ভবিষ্যত। মোট-০৩ পৃষ্ঠা
টাকা! এই কাগজের টুকরোর উপরে চলছে সারা দেশের লেনদেন।
কিন্তু টাকাই কি শেষ? অর্থ ব্যবস্থার লেনদেনের জন্য এসেছে প্লাষ্টিক কার্ড, চলছে মোবাইল
লেনদেন, তাহলে টাকার ভবিষ্যত কি? আর বাংলাদেশে টাকার শুরুই বা কিভাবে?
স্বাধীন বাংলাদেশের
টাকার ইতিহাস: ১৯৭১ সাল, বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৯ মাসের
সংগ্রামের পর তখন একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশ আমাদের। এমনকি নিজেদের কোন টাকাও ছিল না। সুতারাং
তখনো বাংলাদেশে পাকিস্তানের টাকারই প্রচলন ছিল। তখনকার পাকিস্তানি নোটের পাশে রাবার
স্ট্যাম্প দিয়ে বাংলাদেশ সিল দেয়া থাকতো। তখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা আজকের মত
জটিল ছিল না। ফলে আমাদের ব্যাংকে পাকিস্তানি যত টাকা ছিল সেটা দিয়ে চালু হল অর্থনীতি।
বাংলাদেশের প্রথম টাকা ছাপানো হল ভারতে। ভারতের মুম্বাইয়ের
কাছাকাছি নাসিক নামক স্থানে ভারতীয় এক সিকিউরিটি প্রেস থেকে ১৯৭২ সালের ৪ মার্চ এক
ও একশত টাকার নোট ছেপে আনা হল। এসব নোটের ডিজাইনে কোন বিশেষত্ব ছিল না, ছিল না কোন
সিকিউরিটি। একারণে মুদ্রা জাল হওয়ার প্রচুর সম্ভবনা দেখা দেয়। একারণে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী
শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডনের এক সিকিউরিটি প্রেসকে অনুরোধ করেছিলেন বাংলাদেশের টাকা ছাপানোর
জন্য। অবশেষে লন্ডনের সেই প্রেস থেকে ১ম সিকিউরিটি সহ ১০০ টাকার নোট ছাপানো হয়েছিল।
বাংলাদেশের নিজস্ব মুদ্রার নকশার ইতিহাস:
প্রাথমিক সমস্যা কাটিয়ে ওঠার পর বঙ্গবন্ধু নির্দেশ
দিলেন আমাদের দেশের শিল্পীদের দিয়ে নিজস্ব ডিজাইনে এক টাকা ছাপানোর। এটির ডিজাইনের
দ্বায়িত্ব দেয়া হয় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, পটুয়ার কামরুল হাসান, শিল্পী কে.জি মোস্তফা,
শিল্পী কাউয়ুম চৌধুরী ও শিক্ষাবিদ নীলিমা ইব্রাহিমকে। জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসানের
পরামর্শে শিল্পী কে.জি মোস্তফা এক টাকার নোটের দুটি নকশা তৈরি করেন।
নতুন ডিজাইনের নিজস্ব টাকা চালু হল ১লা মার্চ, ১৯৭৩
সালে। কিন্তু তখনও বাংলাদেশে ভারতীয় টাকার প্রচলন ছিল। তাই এর ঠিক একদিন পর অচল ঘোষনা
হল পুরনো পাকিস্তানী আর ভারতীয় মুদ্রা। সবাই তাদের কাছে থাকা পাকিস্তানি টাকা ব্যাংকে
জমা দিয়ে বিনিময়ে পেলেন বাংলাদেশের নিজের টাকা।
এরপর থেকে টাকার নানা বিবর্তন হয়েছে। বিভিন্ন মূল্যমানের নোট ছাপানো হয়েছে। শুধু তাই নয় টাকা নিয়ে চলেছে রাজনীতিও। প্রথমদিকে টাকার উপরে শোভা পেয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম, বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ এবং শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের বিখ্যাত পেইন্টিং গরু দিয়ে হাল চাষ। বঙ্গবন্ধু প্রণীত ছাপানো কাগজের টাকার পাশাপাশি পলিমারের টাকাও ছাপানো হয়েছিল ২০০০ সালে। কিন্তু অষ্ট্রেলিয়ায় ছাপানো এই টাকার নোট তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। দেশের প্রচলিত টাকা বাহিরেও বিশেষ দিন স্বরণীয় করতে ছাপানো হয়েছে বিশেষ ধরণের নোট। যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪০ বছর উপলক্ষে ছাপানো হয় ৪০ টাকার নোট। তেমনি স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে ছাপানো হয়েছে বিশেষ নোট।
বাংলাদেশের কোথায় এবং কিভাবে টাকা ছাপানো হয়:
এত যেসব টাকা ঘোরে মানুষের হাতে হাতে, ব্যাংকে, ব্যাংকের
ভল্টে কিন্তু প্রশ্ন হল এসব টাকা ছাপানো হয় কোথা থেকে? নতুন টাকা ছাপানোর কাজ একটি
বিশেষ প্রকৃয়ার মাধ্যমে হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে নতুন টাকা ছাপানোর নির্দেশপত্র বাংলাদেশের
কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আসতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের কারেন্সি
ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের একমাত্র টাকা ছাপানোর প্রতিষ্ঠান দি সিকিউরিটি
প্রিন্টিং কর্পোরেশন (টাকশাল) কে নতুন মুদ্রা ছাপানোর নির্দেশ জারি করে।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নির্দেশনাপত্র পাবার পরই টাকশাল
নতুন মুদ্রা ছাপানোর কাজ শুরু করে। টাকা ছাপানোর বিভিন্ন ধাপে ধাপে নিরাপত্তা সংক্রান্ত
যে বিষয়গুলো রয়েছে অর্থাৎ নোটের যে নিরাপত্তা বৈশিষ্ঠ্যগুলো রয়েছে সেগুলো বিভিন্ন ধাপে
ধাপে টাকার মধ্যে যোগ হতে থাকে। ছাপানো টাকাকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার জন্য টাকশালে
অনেক এক্সামিনার রয়েছেন। এই এক্সামিনারগণ গভীরভাবে প্রত্যেকটা শিট, প্রত্যেকটা নোট মেনুয়্যালি
পরীক্ষা করে। ভাল নোটগুলোকে অটোমেটিক মেশিনে নাম্বারিং করা হয়। নাম্বারিং করার পরে
প্রত্যেকটা নোটকে আলাদা আলাদা করে কাটা হয় এবং প্রতি ১০০টা নোট নিয়ে একটা প্যাকেট করা
হয়। আবার প্রডাকশনের প্রতিটা স্তরে স্তরে যাচাই, বাছাই ও হিসেব করা হয়, কোয়ালিটি দেখা
হয় এবং গণনা করা হয় যে কতগুলো শিট কোথায় যাচ্ছে। টাকার শিটগুলো যখন একজনের হাত থেকে
আরেকজনের হাতে স্থানান্তরিত হয় তখন সবাই সেগুলো অত্যন্ত কঠোরভাবে চেক এবং রিচেক এর
মাধ্যমেই বুঝে নেয়।
১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস টাকশাল
প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশে কাগজে টাকা ছাপানোর যাত্রা শুরু হয়। তার আগ পর্যন্ত টাকা ছাপানো
হত ইংল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি সহ আরও কয়েকটি দেশে। তবে দেশে টাকা তৈরিতে অধিকাংশ
কাঁচামাল এবং সব ধাতব মুদ্রা এখনো বিদেশ থেকেই আমদানি করতে হয়।
চাইলেই কি
টাকশালে যেকেউ টাকা ছাপিয়ে নিতে পারবে বা চুরি করতে পারবে?
চাইলেই কি এত টাকা ছাপানো যায় বা আমদানি করা যায়?
এই যে এত এত কাগজের টাকা আর ধাতব মুদ্রা বা পয়সা কি পরিমাণে ছাপা হবে তাই বা ঠিক হয়
কিভাবে?
বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন টাকা ছাপানোর জন্য দি সিকিউরিটি
প্রিন্টিং কর্পোরেশনকে এক বা দুই বছর আগে থেকেই রিকোজিশন দিয়ে থাকে যাতে প্রডাকশনে
এক বছর দেরি হলেও কোন সমস্যা না হয়। একদম নির্দিষ্টভাবে ঠিক কত টাকা ছাপাতে হবে তার
পুরো নির্দেশনা আসে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া কোন টাকা
ছাপানো যায় না।
এত এত টাকা ছাপাতে গিয়ে প্রতি বছর কত টাকাই বা নষ্ট
হয়?
রিকনসিলিয়েশন অর্থাৎ একটা কাগজে মোট কতগুলো নোট হবে
এর মধ্যে কয়টা ভাল নোট হবে এবং কয়টা নষ্ট নোট হবে তা হিসেব করা হয়। এরপর সবগুলো নষ্ট
নোটকে হিসেব করে সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতেই সেগুলোকে ধ্বংস করে ফেলা
হয়।
পৃষ্ঠা ২
কাগজের নোটের ভবিষ্যত:
আমরা যা কিছুই করি না কেন তাতে টাকা লাগবেই আর টাকা
বহনেও আছে ঝুঁকি ও বিড়ম্বনা। তাই হয়তো কাগজের টাকার দিনও যেন ফুরিয়ে আসছে। অনেক দেশেই এখন
ক্যাশ টাকার লেনদেন প্রায় বন্ধ। টাকার জায়গা নিতে প্রথমে এসেছে প্লাষ্টিক কার্ড, এরপর
এলো ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেসবকে ছাপিয়ে এখন মোবাইলের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনের যেন জয়যাত্রা।
জরুরী বা যেকোন প্রয়োজনে দিনে রাতে ২৪ ঘন্টা যেকোন জায়গায় টাকা পাঠানো, মোবাইল রিচার্জ,
পাড়ার মুদিখানা থেকে সুপার শপ কিংবা অনলাইনে কেনাকাটা, রাইড শেয়ার, ডেলিভারি সেবার
পেমেন্ট, ঘরে বসে যেকোন ইউটিলিটি বিল পরিশোধ, স্কুল কলেজের ফি দেয়া, যেকোন যাত্রার
টিকিট কেনা, বেতন, রেমিটেন্স, সরকারি বৃত্তি, ভাতা ও অনুদান গ্রহণ, ব্যাংকের সাথে লেনদেন,
লোন, সেভিং স্কিম গ্রহণের মত আর্থিক লেনদেন সবই হচ্ছে বিকাশ, নগদ, রকেটের মত মোবাইল
আর্থিক সেবা দিয়ে।
অতিমারী করোনা আসাতে ক্যাশ লেনদেন যেন আরও কমে গেছে।
সবমিলিয়ে নির্ভরতা বাড়ছে আর্থিক মোবাইল লেনদেনে। মানুষের এই অভ্যস্থতায় প্রশ্ন জাগে
ক্যাশ টাকার লেনদেন ভবিষ্যতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে বা টাকার ভবিষ্যতই বা কি?
আর্থিক বিনিময় কালের বিবর্তনে পরিবর্তনশীল হচ্ছে যেমন
অতীতে পণ্য বিনিময় প্রথা, সেখান থেকে স্বর্ণমুদ্রা, এরপর কাগুজে টাকা বর্তমানে আবার
অনলাইন ট্রানজেকশন। বিনিময় প্রথার বিবর্তনের এই ধারাটি যদি এর বর্তমান গতি বজায় রাখে
তবে ধারণা করা যায় যে আগামী ১০ বা ১৫ বছরের মধ্যে হয়তো অনেক ক্ষেত্রে কাগজের টাকার
ব্যবহার কমে যাবে। অনলাইন ট্রানজেকশন সিস্টেম লেনদেনকে করে আরও সহজ ও সাবলীল। যেমন
কাগজের নোটের ক্ষেত্রে যেটা হয় যে ধরুন একজন ব্যবসায়ী প্রতিদিন তার লেনদেনে যে পরিমাণ
টাকা গুনেন সেটা যদি হিসেব করা হয় তাহলে দেখা যাবে হয়তো তিনি কয়েক ঘন্টা ব্যয় করেছেন
শুধুমাত্র টাকা গুনতেই। তাই অর্থ লেনদেন ব্যবস্থাকে যদি অনলাইন ট্রানজেকশনের মত কার্যকর
কোন পদ্ধতির মধ্যে নিয়ে আসা যায় তাহলে লেনদেনের ক্ষেত্রে মানুষের সময় অনেক সাশ্রয় হবে।
কারণ ডিজিটাল ট্রানজেকশনের ক্ষেত্রে কোটি টাকার হিসেবও সেকেন্ডের মধ্যে দেখা যায়। তাই
লেনদেনের বিষয়গুলো যত ডিজিটালি হবে ততই গ্রাহক, ব্যবসায়ী, জনগন, সরকার এবং সর্বোপরি
পুরো ব্যাংকিং সিস্টেমের লেনদেন একটি চুড়ান্ত কার্যকর ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে পরিচালিত
হবে।
বিংশ শতাব্দীতে ডিজিটাল ট্রানজেকশনের চ্যালেঞ্জ নিতে আমরা কতখানি প্রস্তুত! সরকারের সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত আর উদ্যোক্তাদের দূরদর্শীতায় বিকাশ, নগদসহ আরও কিছু মোবাইলভিত্তিক অর্থনৈতিক সেবা প্রতিনিয়ত তাদের আপডেট করে জানিয়ে দিচ্ছে সে প্রস্তুতির কথা।
***** সমাপ্ত *****