সাত ভাইয়ের এক বোন || ঠাকুরমার ঝুলি ৪

 

সারমর্ম: সাত ভাইয়ের একমাত্র বোন পঙ্কাবতীকে তার হিংসুটে বড় ছয় ভাবি ভাইদের অনুপস্থিতিতে শাস্তিস্বরুপ যেখানে পাঠিয়ে দিয়েছিল। ভাইয়েরা ফিরে এসে কখনো কি পেয়েছিল পঙ্কাবতীর খোঁজ জানতে পুরো গল্পটি পড়ুন। মোট-০৪ পৃষ্ঠা


এক সদাগরের সাত ছেলে আর এক মেয়ে ছিল। মেয়েটি ছিল খুবই সুন্দরী। সদাগর মানুষটি ছিল ভীষণ সৎ। বহু কষ্টে বড়লোক হয়েছে। এক এক করে বিয়ে দিয়েছে সাত ছেলের। কিন্তু এই সুখ বেশি দিন কপালে সইলো না, একদিন সদাগর ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে স্বর্গলোকে গমন করল। তার এক বছর পর সদাগর পত্নীও মারা গেল।

সাত ভাই সাত বৌ নিয়ে একই সাথে বসবাস করে, মাঝে মাঝে ছোট বোন শ্বশুরবাড়ি থেকে এসে কয়েক দিন ভাইদের সাথে কাটিয়ে যায়। সাত বৌ এর মধ্যে ছোট বউটি ছিল অপেক্ষাকৃত ভাল, একমাত্র ননদ পঙ্কাবতীকে সে খুব ভালবাসতো, আর অন্যান্য বউরা পঙ্কাবতীকে একদম সহ্য করতে পারতো না। সাত ভাইয়ের বড় আদরের এই পঙ্কাবতী। প্রতি বছরের শুরুতেই পঙ্কাবতী কয়েকদিনের জন্য ভাইদের বাড়িতে আসত। বেশ কিছুদিন থাকত। এবারও যথারীতি বছরের শুরুতে পঙ্কাবতী ভাইদের বাড়িতে উপস্থিত হল। একমাত্র বোনকে পেয়ে সাত ভাই তো মহাখুশি, কিন্তু এদিকে আবার বাণিজ্য যাত্রার দিন প্রায় ঘনিয়ে এসেছে, তাই তাদের মন খারাপ, যাত্রার প্রক্কালে সাত ভাই সাত বউকে বলল আমাদের একমাত্র বোনকে তোমাদের কাছে রেখে যাচ্ছি। তার আদর যত্নের কোন কমতি রাখবে না, আর বোনের শ্বশুর বাড়ি থেকে নিতে এলে বলে দিও আমরা ফিরে এসে পৌঁছে দিয়ে আসব।

স্বামীদের উপদেশে সাত বউ মাথা দুলিয়ে বলল, তোমরা নিশ্চিন্ত মনে বাণিজ্য সেরে এসো। সাই ভাই বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে চলে গেল। এদিকে এতদিনে ননদকে একাকী পেয়ে বড় ছয় বউ তার সাথে নানা রকম দুর্ব্যবহার করতে লাগল। এই ভাবে বেশ কিছুদিন কেটে গেল। পঙ্কাবতীর মনে সুখ নেই, শ্বশুরবাড়িতে ফিরে যাবার জন্য সে ব্যস্ত হয়ে উঠল। এমনি এক দিন একটা পালকি এসে তাদের বাড়ির সামনে দাঁড়ালো। ছয় বউ পালকি দেখে বুঝতে পারল, ননদকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার শ্বশুরবাড়ি থেকে পালকি পাঠিয়েছে।

ছয় বউ তখন পালকির চালকদের বলল, ওর দাদারা বাড়ি নেই, এখন তো আমরা যেতে দিতে পারি না। দাদারা আসুক, তারা নিশ্চয়ই বোনকে শ্বশুর বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবে। আপনারা ফিরে গিয়ে এই কথা বলুন।

পালকির চালক বলল বৌদিমণির আত্মীয়ের বিয়ে এমতাবস্থায় খালি পালকি নিয়ে গেলে রাজাবাবু অসস্তুষ্ট হবেন। আপনারা বরং বৌদিমণিকে আজকের মত পাঠিয়ে দিন, আমরা আবার পৌছে দিয়ে যাব।

এদিকে শ্বশুরবাড়ি থেকে পালকি এসেছে শুনে পঙ্কাবতী সাজগোজ শুরু করে দিল। ছয় বউ মনে মনে ভাবল কয়েকটি দিনের তো মামলা, তার পরেই ফিরে আসবে তখন আবার শায়েস্তা করা যাবে, এই ভেবে তারা পঙ্কাবতীকে বাধা দিল না।


পৃষ্ঠা ১



বড় বৌদির একটা লাল রঙের শাড়ি ছিল, পঙ্কাবতীর সেই শাড়িটা খুব পছন্দ, তাই যাওয়ার আগে বলল বড় বৌদি তোমার ঐ লাল শাড়িটা দেবে, বিয়েতে পরব?

এটা শুনে বড় বউ মনে মনে রাগ হলেও মুখে প্রকাশ করল না। বড় বউ পঙ্কাবতীর হাতে শাড়িটা তুলে দিয়ে বলল দেখ বাপু আমার এই একটা মাত্র ভাল শাড়ি, তুমি চেয়েছো তাই দিলাম। তুমি এই শাড়ি বিয়েতে পর আর যাই কর, তা দেখে আমার কোন কাজ নেই। কিন্তু আমি তোমাকে যে অবস্থায় শাড়িটা দিচ্ছি, তুমি ঠিক সেই অবস্থায় আবার এটি ফিরিয়ে দিবে আমাকে।

পঙ্কাবতী হাসতে হাসতে বলল না গো বৌদি, তোমার কোন চিন্তা নেই, আমি যে অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছি ঠিক সেই অবস্থায় আবার ফিরিয়ে দেব।

পঙ্কাবতী লাল শাড়িটা অতি যত্নে বাক্সে ঢুকিয়ে নিয়ে পালকিতে করে শ্বশুড় বাড়ির উদ্দেশ্যে চলল।

বিয়ের দিন বাড়ির সকলেই নতুন নতুন দামি শাড়ি পরেছে। পঙ্কাবতী বড় বৌদির শাড়িটা পরে বিয়ের আসরে আসতে ননদ ঠাট্টা করে শাড়িতে একটু হলুদ লাগিয়ে দিল সঙ্গে সঙ্গে পঙ্কাবতী কেঁদে উঠল। বলল এ তুমি কি করলে? এটা বড়বৌদির শাড়ি, এবার কি হবে? জান, বড়বৌদি শাড়ি আনার সময় কি বলেছে?

উপস্থিত সবাই পঙ্কাবতীর ব্যবহারে অবাক হয়ে গেল। পঙ্কাবতীর ননদ বলল কেন কি বলেছে তোমার বড়বৌদি?

চোখের জল মুছতে মুছতে পঙ্কাবতী বলল বলেছে যদি শাড়ি নষ্ট হয় তবে আমাকে ঢেঁকিতে কুটে চালুনে চেলে সারকুড়ে ফেলে দেবে।

পঙ্কাবতীর কথায় সবাই হোঃ হোঃ করে হেসে উঠল। অপেক্ষাকৃত বয়স্ক মহিলাটি হাসতে হাসতে বলল ওরে, তুই ঠাট্টা বুঝিস না? তোর সাথে বড় বউ ঠাট্টা করেছে।

পঙ্কাবতী মনে মনে ভাবলো কেঁদে আর কি হবে, যা হবার তা তো হবেই, কপালে যা আছে তাই হবে।

বিয়ের ঝামেলা মিটে গেলে পঙ্কাবতী ভয়ে ভয়ে পালকি থেকে বাপের বাড়ির সামনে নামলো। বড় বউ তারই অপেক্ষায় ছিল, ননদকে ফিরতে দেখে তাড়াতাড়ি নেমে এসে বলল আমার শাড়ি কোথায়?

পঙ্কাবতী ভয়ে ভয়ে শাড়িটা বড়বৌদির হাতে তুলে দিল। শাড়ি খুলে শাড়িতে হলুদের দাগ দেখে বড় বউ চোখ কপালে তুলে চিৎকার করে বলল একি করেছিস রে হতভাগী। এরপর কপাল চাপড়ে বলল আমার সর্বনাশ করে দিয়েছে, এই দেখ এত সুন্দর শাড়িটার কি দশা করেছে?

বড় বউ তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বলল হতভাগী তোকেও আমি ছাড়বো না এই বলে বড় বউ পঙ্কাবতীর চুলের মুঠি ধরে ঢেঁকিতে কুটে চালুনে চেলে সার কুড়ে ফেলে দিল।

দেখতে দেখতে অনেকদিন কেটে গেল। সারকুঁড়ের মধ্যে গজিয়ে উঠল অনেক পঙ্কা গাছ। একহাত সমান লম্বা লম্বা ডালগুলোর মধ্যে সবুজ সবুজ কচি পাতা ভরে গেল।


পৃষ্ঠা ২



একদিন পঙ্কাবতীর মাসি এল পঙ্কাবতীকে দেখতে। পঙ্কাবতীর বাপের বাড়িতে এসে চিৎকার করে ডেকে উঠল কৈ রে আমার পঙ্কা কতদিন তোকে দেখি না, এবার আয় তো মা।

বড় বউ বুঝতে পারল পঙ্কাবতীর মাসি এসেছে, সে তখন নিচে নেমে এসে বলল ও মাসি কেমন আছে, কখন এলে? এদিক ওদিক তাকিয়ে মাসি বলল এই তো এলাম বাপু, আমার পঙ্কা কৈ? তাকে তো দেখছি না?

বড় বউ বলল ওমা পঙ্কা কি চিরদিনই বাপের বাড়িতে থাকবে নাকি? শ্বশুর বাড়িতে আছে, তুমি ভেতরে এসো মাসি।

পঙ্কাবতী নেই শুনে মাসি দুঃখ করে বলল এতটা পথ কষ্ট করে এলাম মেয়েটাকে দেখার জন্য, সে আর ভাগ্য হল না, তা দু’দিন তোমার কাছে কাটিয়ে যাই।

পরদিন সকালে পঙ্কাবতীর মাসি ঘুরতে ঘুরতে সারকুঁড়ের সামনে হাজির হয়ে সতেজ পঙ্কা গাছ দেখে উৎফুল্ল হয়ে বলল ও বড় বউ মা, একবার এদিকে এসো তো, দেখ কি সুন্দর গাছ হয়েছে। পঙ্কা পাতার শাঁক কি ভালই না খেতে, আজ তোমাদের জন্য আমি পঙ্কাশাক রান্না করব।

এই বলে পঙ্কাবতীর মাসি পঙ্কাপাতা তুলতে গেলেই হঠাৎ শুনতে পেল কে যেন বলছে

ছিঁড়ো না ছিঁড়ো না পাতা মাসি

আমি পঙ্কাবতী।

বড় বৌদির শাড়ি পরে,

আজ আমার এই দুর্গতি।

গাছ কথা বলতে পারে! এর আগে কখনও শোনেনি পঙ্কাবতীর মাসী। অবাক হয়ে সে বড় বউকে ডেকে বলল বড় বৌমা দেখ কি অবাক কাণ্ড! পঙ্কা গাছ কথা বলছে।

বড় বউ ব্যাপারটা চাপা দেওয়ার জন্য ঝাঁঝের গলায় বলল মাসি দিনে দিনে তোমার বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। এই সারকুঁড়ে থেকে কেউ শাক তুলে খায়? এই বলে বড় বউ পঙ্কা শাক তুলে ফেলে দিল। আর আশ্চর্যের বিষয় জলে ফেলার সাথে সাথে পঙ্কাগাছগুলো একত্রিত হয়ে একটা জলপদ্ম হয়ে গেল।

পরদিন নৌকা করে পঙ্কাবতীর সাত ভাই বাণিজ্য করে ফিরে এল। একমাত্র বোনের জন্য তারা কত সুন্দর সুন্দর জিনিস এনেছে। মনে মনে সাত ভাই ভাবছে এই জিনিসগুলো পেয়ে তাদের বোন খুব খুশি হবে। ঘাটে নৌকা ভেড়ালে বড় ভাই দেখলো নদীর মধ্যিখানে একটা সুন্দর পদ্মফুল ফুটে আছে।

ছোট ভাই পদ্মফুল তুলতে গেলে শুনতে পেল, পদ্মফুল বলছে— “নিও না আমায়, আমি পঙ্কাবতী

বড়ো বৌদির শাড়ি পরে, আজ আমার এই দুর্গতি।

পদ্মফুলের ছড়া শুনে ছোট ভাই অবাক। সঙ্গে সঙ্গে ঘাটে ফিরে অন্যান্য ভাইদেরকে সে সবকিছু খুলে বলল। সব শুনে সাত ভাই সাতটি নৌকা নিয়ে পদ্মফুলটাকে ঘিরে ফেলল, বড় ভাই পদ্মফুলের বোঁটা ছিড়ে নিল, সঙ্গে সঙ্গে পদ্মফুল থেকে বেরিয়ে এল তাদের একমাত্র আদরের বোন পঙ্কাবতী। এ হেন ঘটনা পঙ্কাবতী দাদাদের সব খুলে বলল। সব শুনে সাত ভাই বোনকে লুকিয়ে রেখে বাড়ির পথে যাত্রা করল।


পৃষ্ঠা ৩



বাড়িতে ফিরে বড় ছয় বউকে ডেকে বড়ভাই জিজ্ঞাসা করল পঙ্কাবতী কোথায়? বড় বউ বলল কেন? পঙ্কা তো তোমরা যাওয়ার পরই শ্বশুর বাড়িতে চলে গেছে। বড় ভাই তখন পঙ্কাবতীর শ্বশুর বাড়িতে খবর পাঠাল। শ্বশুর বাড়ির লোক এসে বলল পঙ্কা সেখানে নেই বাপের বাড়িতে আছে।

বড় ভাই এবার সাত বউকে জিজ্ঞাসা করতে লাগল যে পঙ্কা কোথায়? কোন বউই আসল ঘটনা বলল না, কিন্তু ছোট বউকে জিজ্ঞাসা করলে সে প্রথম থেকে সবকিছু খুলে বলল। সব শুনে সাত ভাই রেগে ছয় বউকে জ্যান্ত মাটির নিচে পুঁতে দিল।

তারপর আবার ছয় ভাই বিয়ে করল। নতুন বউরা কিন্তু আগের ছয় বউয়ের মত নয়। তারা পঙ্কাবতীকে খুব ভালবাসে।


***** সমাপ্ত *****

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post