দরিদ্র ব্রাহ্মণ ও ব্রহ্ম দৈত্য || ঠাকুরমার ঝুলি ২

 

সারমর্ম: জমিদারের সাথে বাজি ধরে এক ব্রাহ্মণ গিয়েছিল মানুষখেকো ভয়ংকর ভূতেদের আস্তানায়। ভূতেরা ব্রাহ্মকে ঘিরে ধরে তার সাথে যা ব্যবহারটা করলো। মোট-৩ পৃষ্ঠা


এক দরিদ্র ভিখারী ব্রাহ্মণ নগরের এক কোণে বৌ নিয়ে কুঁড়ে ঘরে বাস করেন। সারাদিন ঘুরে ভিক্ষে করে রাতে স্বামী স্ত্রী সেই ভিক্ষের পয়সায় চাল ডাল কিনে ফুটিয়ে খায়। এই ভাবেই তাদের দিন কেটে যাচ্ছিল, এমনি একদিন দরিদ্র ব্রাহ্মণ ভিক্ষা করতে করতে উপস্থিত হল সেই নগরের জমিদার বাড়িতে। জমিদার নতুন এসেছে। দরিদ্র ব্রাহ্মণ প্রতিবেশিদের মুখে শুনেছিল বর্তমান জমিদার খুব ভাল। সেই আশায় দরিদ্র ব্রাহ্মণ আজ কাছারী বাড়িতে এসেছে। একঘর লোক কাছারী ঘরে চিৎকার করে কথা বলছে, কৌতুহলী হয়ে দরিদ্র ব্রাহ্মণ কাছারী ঘরের সামনে গেল, শুনতে পেল একজন বলছে নগরের উত্তর প্রান্তে বড় অশ্বত্থ গাছে নাকি একটা ব্রহ্মদৈত্য বাস করে। দিনের বেলা ব্রহ্মদৈত্যকে দেখা যায় না, তবে রাত্রির অন্ধকারে সেই অশ্বত্থ গাছ থেকে ব্রহ্মদৈত্য মাঠে নেমে আসে। অনেকদিন আগে একবার নাকি নগরের এক ব্রাহ্মণ বাজি ধরে রাতের বেলায় সেই অশ্বত্থ গাছের তলায় যায়। ফলে যা হবার তাই হল, ব্রহ্মদৈত্য তাকে গাছের নীচে মেরে ফেলে।

জমিদার এসব শুনে বলল ঠিক আছে, যে ব্যক্তি রাত্রিতে একা গিয়ে ঐ অশ্বত্থ গাছের একটি ডাল ভেঙে আনতে পারবে, আমি তাকে দুশো বিঘা জমি দেব।

দুশো বিঘা জমির আশায় উপস্থিত সকলেরই চোখ চক্ চক্ করে উঠল, কিন্তু কার এত সাহস আছে যে রাতের অন্ধারে ঐ অশ্বত্থ তলায় যায়, সবাই চুপ করে যে যার বাড়িতে ফিরে গেল। এদিকে গরীব ব্রাহ্মণ বাড়িতে ফিরে ভাবছে যদি একবার অশ্বত্থ গাছের একটা ডাল ভেঙ্গে আনা যায় তাহলে আর এত কষ্ট করে সারাদিন ঘুরে ভিক্ষা করতে হবে না। আর যদি তা না হয় তবে ব্রহ্মদৈত্যর হাতে তাকে প্রাণ দিতে হবে। এইভাবে বেঁচে থাকার চাইতে বরং মরে যাওয়াই অনেক ভাল।

এই সব ভেবে পরদিন সকালে গরীব জমিদারের সাথে দেখা করে বলল মহাশয় যদি অনুমতি দেন তবে আজ রাতেই আমি অশ্বত্থ গাছের ডাল ভাঙ্গতে যাব। জমিদার ব্রাহ্মণের কথায় আকাশ থেকে পড়লেন। তারপর সমনে নিয়ে বললেন ঠিক আছে, তুমি যদি অশ্বত্থ ডাল ভেঙে ফিরে আসতে পার, তবে আমি আমার প্রতিশ্রুতি মত তোমাকে পুরস্কৃত করব।

উপস্থিত জনতা ব্রাহ্মণের কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠল। বলল বুড়ো বয়সে বীরত্ব দেখাতে যাচ্ছ না মরতে যাচ্ছ? কত পুরুষ দেখলাম।

আর একজন বলে উঠল বুড়ো দশা ঐ ক্ষেপা বামুনের মতই হবে দেখবেন।

কাছারী থেকে দরিদ্র ব্রাহ্মণ বাড়িতে ফিরে তার স্ত্রীকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলল, রাত্রিতে ব্রাহ্মণের এক অশ্বত্থতলায় যাওয়ার কথা শুনে ব্রাহ্মণী কান্না জুড়ে দিল। তারপর স্বামীর পায়ে হাত রেখে বলল তুমি যদি অশ্বত্থতলায় যাও তবে আমার মরা মুখ দেখবে।


পৃষ্ঠা ১



ব্রাহ্মণীর কথায় ব্রাহ্মণ একটু বিচলিত হয়েছিল বটে, কিন্তু তাই বলে তার পরিকল্পনা থেকে সরে দাঁড়াল না। গভীর রাতে যখন ব্রাহ্মণী গভীর নিদ্রায় মগ্ন তখন সন্তর্পণে ব্রাহ্মণ কুঁড়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর ঈশ্বরের নাম নিয়ে অশ্বত্থতলার উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগল, চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, জনমানব শূন্য রাস্তাঘাট, ব্রাহ্মণের গা ছম ছম করে উঠল। কদম তলায় যাওয়ার পর ব্রাহ্মণের আর পা চলছিল না, ঠক ঠক করে কাঁপছিল, মনে মনে ভগবানের নাম জপ করছিল। কদম তলা থেকে অশ্বত্থ তলা এখনও সিকি (এক-চুতর্থাংশ) মাইল দূরে।  ব্রাহ্মণের মনে হচ্ছিল, এই বুঝি ভুতেরা তার গলা টিপে মেরে ফেলবে। তার মনে হচ্ছে চোখের সামনে হাজার হাজার ভুত নৃত্য করা শুরু করে দিয়েছে।

ঐ কদম গাছে থাকত এক ব্রহ্মদৈত্য, সে গাছের ডালে বসে তীক্ষ্ম নজরে ব্রাহ্মণকে দেখছিল। ব্রহ্মদৈত্যদের মধ্যে আবার ভালমন্দ আছে। এই ব্রহ্মদৈত্যটি ছিল খুব ভাল। ব্রাহ্মণকে এই ভাবে গাছের নীচে ঠক্ ঠক্ করে কাঁপতে দেখে তার মনে মায়া হল, গাছ থেকে নেমে ব্রাহ্মনের সামনে এসে ব্রহ্মদৈত্য নরম সুরে বলল এত রাতে তুমি এখানে কি করছে?

ব্রাহ্মণ এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে দুর্গার নাম জপ করছিল। মানুষের মতো কণ্ঠস্বর শুনে চোখ খুলে যেই না দেখল তার সামনে বিকট এক ব্রহ্মদৈত্য দাঁড়িয়ে আছে, সে তখন চিৎকার করতে যাচ্ছিল। ব্রহ্মদৈত্য ব্রাহ্মণের মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল তোমার কোন ভয় নেই, আমি তোমার কোন অনিষ্ট করব না।

ব্রাহ্মণ ব্রহ্মদৈত্যের কথা বিশ্বাস করে তাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। সবকিছু শুনে ব্রহ্মদৈত্য বলল ও এই ব্যাপার। ঠিক আছে আমি তোমাকে অশ্বত্থতলায় নিয়ে যাচ্ছি।

এই বলে ব্রহ্মদৈত্য ব্রাহ্মণকে অশ্বত্থতলায় নিয়ে গেল। তারপর ব্রহ্মদৈত্য বলল এবার তুমি তোমার পছন্দমত ডাল ভেঙ্গে নাও।

যেই না ব্রাহ্মণ গাছের ডালে হাত দিয়েছে সঙ্গে সঙ্গে একশ ভুত গাছ থেকে লাফিয়ে ব্রাহ্মণকে ধরল, ব্রাহ্মণের অবস্থা তো তখন দেখার মত, চোখ বন্ধ করে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। ভূতেরা ব্রাহ্মণকে তো ছিঁড়ে খায় খায় অবস্থা।

এসব দেখে অবশেষে ব্রহ্মদৈত্য ব্রাহ্মনের কাছে এগিয়ে ভূতদের উদ্দেশ্যে বলল দেখ তোমরা এই দরিদ্র ব্রাহ্মনের ক্ষতি করো না।

দাদাঠাকুরের গলার শব্দে ভূতেরা চমকে উঠে বলল দাদাঠাকুর আপনি?

হ্যাঁ, আমিই একে নিয়ে এসেছি, এ ভীষণ গরীব। এই বলে ব্রহ্মদৈত্য ভূতদের কাছে ব্রাহ্মণের বাজী ধরার কথা বলল।

সব শুনে ভূতেরা মিলিত কণ্ঠে বলল দাদাঠাকুর আমরা বুঝতে পারিনি যে আপনার সাথে এসেছে, আমরাই বরং ভেঙ্গে দিচ্ছি ডাল। এই বলে ভূতেরা অনেকগুলো ডাল ভেঙ্গে ব্রাহ্মণের হাতে দিল। ব্রাহ্মণ খুশি হয়ে অশ্বত্থ ডালগুলো নিয়ে সেই রাতেই উপস্থিত হল জমিদারবাবুর বাড়িতে।


পৃষ্ঠা ২



রাত তখন প্রায় শেষ প্রহর। জমিদার নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছিল, ব্রাহ্মণকে ডাল কাঁধে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিরক্ত হয়ে বলল কি ব্যাপার এত রাতে ষাঁড়ের মত চিৎকার করছ কেন?

ব্রাহ্মণ বিগলিত স্বরে বলল জমিদারবাবু আমি আমার কথা রেখেছি, এই সেই অশ্বত্থ ডাল।

জমিদারবাবুর চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেল, আকাশ পরিষ্কার হওয়ার সাথে সাথে জমিদার লোক-লস্কর নিয়ে উপস্থিত হল সেই অশ্বত্থতলায়, সত্যি সত্যি দেখল বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের কাঁধের ডালগুলো এই অশ্বত্থগাছেরই ডাল। জমিদারবাবু ব্রাহ্মণের সাহসের প্রশংসা করতে লাগল। বলল হে দরিদ্র ব্রাহ্মণ, আজ থেকে জানলাম, আমার এই নগরে সেরা সাহসী ব্যক্তি তুমি, আমার প্রতিশ্রুতি মত তোমাকে দুশো বিঘা জমি উপহার দিলাম।

এখানে একটা ছবি দাও

ব্রাহ্মণ খুশি হয়ে দুশো বিঘা জমি দেখতে গিয়ে দেখল ধান সব পেকে আছে। সোনালী আলোয় চারিদিক ঝলমল করছে, কিন্তু এত ধান কাটার পয়সা দরিদ্র ব্রাহ্মণ পাবে কোথায়? ধান ক্ষেতের পাশে বসে গালে হাত দিয়ে ভাবতে লাগল। মনে পড়ে গেল ব্রহ্মদৈত্যের কথা। সেদিন সন্ধ্যেবেলা আবার উপস্থিত হল বকুলতলায়। ব্রহ্মদৈত্য বকুলগাছ থেকে নেমে এসে বলল কি হে ব্রাহ্মণ, আবার কি বাজী ধরেছো নাকি?

কৃতজ্ঞচিত্তে দরিদ্র ব্রাহ্মণ বলল আপনার জন্য আমি দুশো বিঘা জমির মালিক হয়েছি ঠিকই, তবে ঐ জমিতে সব ধান পেকে গেছে, সেই ধান তোলার মত আর্থিক ক্ষমতা আমার নেই, তাই পুনরায় আপনার শরণাপন্ন হলাম।

সব শুনে ব্রহ্মদৈত্য বলল ও এই ব্যাপার! তার জন্য এত ভাবনা কিসের? তুমি আজ রাতে একশ কাস্তে এই গাছের নীচে রেখে যেও, আগামীকাল ভোরে ঘুম থেকে উঠেই দেখতে পাবে তোমার বাড়ির চারিদিকে গোলাভর্তি ধান রাখা আছে।

সেদিন রাতেই ব্রাহ্মণ বাড়ি বাড়ি ঘুরে কাস্তে জোগাড় করল। একসময় একশ কাস্তে বকুল গাছের নীচে রেখে বাড়িতে ফিরে এল।

মধ্যরাতে ব্রহ্মদৈত্য একশ ভূতকে ডেকে বলল শোন সবাই, দরিদ্র ব্রাহ্মণ তোমাদের সহযোগিতায় আজ বড়লোক হয়েছে। সে তার জন্য অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানিয়ে গেছে। মানুষ হলেও দরিদ্র ব্রাহ্মণ অকৃতজ্ঞ নয়। এখন কাজের কথা হল, যে দুশো বিঘা জমি সে পেয়েছে, তার সব ধান পেকে গেছে। ব্রাহ্মণের আর্থিক অবস্থা নিতান্তই খারাপ তাই আমাদের মধ্যে একশজন গিয়ে সেই ধান তুলে দিয়ে আসতে হবে।

অপেক্ষা প্রবীণ ভূত বলল দাদাঠাকুর আপনি যা বলবেন তাই হবে।

তবে তোমরা আজ রাতে এই একশ কাস্তে নিয়ে জমির সমস্ত ধান কেটে দরিদ্র ব্রাহ্মণের গোলা ভর্তি করে দাও।

একশ ভূত দাদাঠাকুরের আদেশে কাস্তে নিয়ে জমির ধান কাটতে লাগল। দুশো বিঘা জমির ধান তুলতে তাদের সময় লাগল মাত্র কয়েক ঘন্টা। আসলে মানুষেরা যে কাজ সাতদিনে করে ভূতেরা সেই কাজ কয়েক ঘন্টায় শেষ করে দেয়। কয়েক ঘন্টার মধ্যে সমস্ত ধান নিপুণ হাতে কেটে ব্রাহ্মনের গোলা ভর্তি করে দিল। ব্রাহ্মণ দৈত্যের প্রতি কৃতজ্ঞতায় দরিদ্র ব্রাহ্মণের চোখে জল এসে গেল, মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করল হে ঈশ্বর, ঐ পাপাত্মাকে মুক্তি দিয়ে পুনরায় মানুষরূপে পাঠাও, দেখবে মুনষ্যকূলে দয়াবান ধার্মিক রূপে প্রতিষ্ঠা পাবে।

          

***** সমাপ্ত *****

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post