ডালিম কুমার ও মন্ত্রিপুত্র || ঠাকুরমার ঝুলি ৩

সারমর্ম: রাজ্যের একমাত্র রাজপুত্র ছিল ডালিমকুমার। একমাত্র রাজপুত্র হওয়ায় তার ছিল অনেক শত্রু। রাজপুত্র কি শেষ পর্যন্ত পেরেছিল তার শত্রুদের মোকাবেলা করে বেঁচে থাকতে। সেই কাহিনী জানতে পড়ুন পুরো গল্পটি। মোট-১৪ পৃষ্ঠা


এক ছিলেন রাজা। সেই রাজার ছিল এক বিশাল রাজ্য? এত বড় রাজ্য কোন কিছুরই অভাব নেই। গোলাভর্তি ধান, সারা বছর ধরে ফসল ফলে পর্যাপ্ত রাজকোষ উদ্ধত্ত ধন রত্নকে সমৃদ্ধ করে। প্রজারা সুখে স্বচ্ছন্দে বসবাস করছে। বছরের বেশির ভাগ দিনই রাজ্যে উৎসব লেগে আছে। কিন্তু রাজার মনে সুখ নেই, থাকবেই বা কি করে। কেন না তার কোন সন্তান নেই। মৃত্যুর পর কে এই রাজ্যের ভার নেবে?

রাজার ছিল দুই রানি, দুয়ো আর সুয়ো। সন্তানের অভাবে তাদেরও মনে সুখ নেই। সারাদিন ঈশ্বরের কাছে সন্তানের আশায় উপাসনা করে আর চোখের জল ফেলে। এমনি একদিন রাজবাড়িতে এক সন্ন্যাসীর আবির্ভাব হলো। সন্ন্যাসী সিংহদরজার সামনে চিৎকার করে বলতে লাগল ‘জয় শিব শম্ভু, কে আছে গো ভিক্ষে দিয়ে যাও।’

সুয়োরানির কাছে যাওয়া মাত্রই সোনার থালায় আতপচাল কাচকলা নিয়ে সিংহ দরজার বাইরে এল। সন্ন্যাসী ভ্রু কুঁচকে গম্ভীরকন্ঠে বলল, কি গো তোমার মুখে হাসি নেই কেন?

সুয়োরানি মাথা নিচু করে মন খারাপ করে বলল, ‘মনের কথা কি সবই বলা যায়?’ সুয়োরানির কথা শুনে সন্ন্যাসীর মনে সন্দেহ হল। সে বলল ‘তোমার ছেলেপুলে কটি গো?’ একথা শুনে সুয়োরানি আর চোখের জল সামলাতে পারল না, ঝর ঝর করে কেঁদে মাথা নেড়ে জানান দিল, একটি সন্তানও নেই।

সন্ন্যাসীর মায়া হল, সে সুয়োরানিকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল তোমার মত সতীলক্ষ্মী এখনো মা ডাক শোনেনি? ঠিক আছে, তোমার পুত্রসন্তান হবে। এই নাও এই শিকড় তোমার কাছে রাখ। প্রতিদিন সকালে সূর্য উদয় হওয়ার পূর্বে একশত বার শ্রীকৃষ্ণের নাম নিয়ে ডালিম ফুলের রস দিয়ে শিকড়টাকে ভিজিয়ে আবার তুলে নিও। তারপর ভগবানের নাম করে মুখে ঢেলে দিও। আর একটা কথা মনে রাখবে, খাওয়ার পূর্বে জল মুখে দেবে না, দেখবে আঠারো মাসের মধ্যে তোমার কোল আলো করে তোমার নয়নের মণি আসবে। তার গায়ের রঙ হবে ডালিম ফুলের মতো। তুমি তার নাম রেখো ডালিম কুমার।

সুয়োরানির মন আনন্দে ভরে উঠল, তাহলে এতদিনে ভগবান তার দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছে। আনন্দে দিশেহারা হয়ে সুয়োরানি বারবার সন্ন্যাসীর পায়ের ধুলো নিতে লাগল। সন্ন্যাসী সুয়োরাণীকে বলল তবে একটা কথা মনে রাখবে, রাজকুমারের অনেক শত্রু হবে, তারা রাজকুমারের প্রাণনাশ করার চেষ্টা করবে। রাজপ্রাসাদের সামনে যে পুকুর দেখছো, ওর মধ্যে বাস করে এক রাঘব বোয়াল। তার পেটে আছে একটি চন্দনের কৌটা এবং সেই কৌটার মধ্যে আছে একটি সোনার হার। ঐ সোনার হারটিই কিন্তু রাজকুমারের প্রাণ। ‍তুমি তার জননী তাই তোমাকে জানালাম, আর কাউকো কখনও এ কথা জানাবে না। এই বলে সন্ন্যাসী সুয়োরানিকে আশীর্বাদ করে প্রস্থান করল।


পৃষ্ঠা ১



সুয়োরানি পরদিন থেকেই শুরু করলেন সন্ন্যাসী প্রদত্ত শিকড় ভিজিয়ে ডালিম ফুলের রস পান করা। এই ভাবে একের পর এক দিন কাটতে লাগল। সুয়োরানি এখন আর বিষণ্ন হৃদয় নিয়ে ঘুড়ে বেড়ায়না, সে সব সময়ই প্রাণচঞ্চল থাকে। এই ভাবে প্রায় সাত মাস কেটে গেল। একদিন রাজমাতা আবিষ্কার করলেন, তার পুত্রবধূ সন্তানসম্ভবা। রাজার কানে কথাটা যেতেই আনন্দের সীমা রইল না।

যথা সময়ে সুয়োরানির কোল আলো করে একটি পুত্রসন্তানের জন্ম হল, কি আশ্চর্য তার রূপ, সকলের চোখ ধাঁধিয়ে গেল। সকলে জল্পনা কল্পনা করতে লাগল, এ নিশ্চয়ই ঈশ্বরের সন্তান। রাজার কানে খবর যাওয়া মাত্রই মহারাজ রাজকোষ থেকে প্রচুর ধন রত্ন প্রজাদের দান করলেন। সাত দিন সাত রাত রাজ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল, মহারাজ বার বার ছেলের মুখ দেখেন আর মনে মনে ভাবেন আমি যেমনটি চেয়েছিলাম তেমনটিই পেয়েছি। রাজা আবারো প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠলেন, মন দিয়ে রাজকার্য শুরু করলেন, মন্ত্রি মহলও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। রাজপুত্রের জন্মের আগে রাজকার্যের ব্যাপারে মহারাজ যেমন উদাসীন হয়ে পড়েছিলেন তাতে করে মন্ত্রীদের গালে হাত পড়ে গিয়েছিল।

দেখতে দেখতে রাজকুমার ছয় মাসে পদার্পণ করল। রাজপ্রাসাদের সামনে বিরাট বড় মণ্ডপ হল, রাজকুমারের অন্নপ্রাশন, রাজ্যের সমস্ত প্রজাদের পাঁচদিন নেমন্তন্ন ছিল রাজ বাড়িতে। তারা পেট পুরে মণ্ডা মিঠাই খেলো আর রাজপুত্রকে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করল। সুয়োরানি সন্ন্যাসীর নির্দেশমত ছেলের নাম রাখলেন ডালিম কুমার। রাজকুমারকে নিয়ে রাজবাড়িতে প্রায় প্রতিদিনই উৎসব হতে লাগল।

একের পর এক দিন চলে যায়, রাজকুমার ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। একদিন রাজকুমারের ধুমধাম করে অষ্টম বৎসরের জন্মদিন পালন করা হলো। ডালিম কুমার পায়রা নিয়ে খেলতে খুব ভালবাসত। প্রতিদিন বিকেলে রাজবাড়ি সংলগ্ন মাঠে ডালিম কুমার এক ঝাক পায়রা নিয়ে খেলা করত।

মাঠের ওপ্রান্তে ছিল দুয়ো রানির প্রাসাদ। একদিন বিকেলে ডালিম কুমার পায়রা নিয়ে খেলা করছিল, একটা পায়রা উড়ে গিয়ে বসল দুয়োরানির প্রাসাদে। ডালিম কুমারও সেটির পেছনে ছুটতে ছুটতে চলে এলো দুয়োরানির প্রাসাদে। সে দুয়োরানিকে বলল বড়মা, আমার একটা পায়রা তোমার ঘরে গেছে, পায়রাটা দাও না?

ডালিমকুমারকে দুয়োরানি একদম সহ্য করতে পারতো না। কারণ ডালিম কুমারের জন্মের পর থেকে মহারাজ সুয়োরানিকে নিয়ে সর্বক্ষণ মেতে থাকতেন, দুয়োরানির দিকে ফিরে তাকাতেন না। দুয়োরানি কেমন করে যেন শুনেছিলেন যে, ডালিম কুমারের প্রাণ কোথায় যেন লুকিয়ে রাখা আছে। তাই এই সুযোগ তিনি ছাড়লেন না। ডালিম কুমারকে আদর করে কোলে বসিয়ে বললেন তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করব, সত্যি সত্যি উত্তর দিতে হবে, নয়তো তোমার পায়রা দেব না।

ডালিম কুমার বড়মার কথায় অবাক হয়ে বলল কি এমন কথা বড়মা?

দুয়োরানি বলল না তেমন কিছু না, আচ্ছা ডালিম কুমার তুমি কি জানো যে তোমার প্রাণ কোথায় লুকানো আছে?


পৃষ্ঠা ২



ডালিম কুমার হোঃ হোঃ করে হেসে উঠে বলল তুমি কি বোকা বড়মা, সবার প্রাণ যেখানে থাকে আমার প্রাণও সেখানেই আছে, এইতো আমার বাকের মধ্যিখানেই রয়েছে আমার প্রাণ।

দুয়োরানি বলল না গো পাগল ছেলে, তোমার বুকে তোমার প্রাণ নেই। সন্ন্যাসী তোমার মাকে বলে গেছে যে কোথায় তোমার প্রাণ রাখা আছে। আমি সেই জায়গাটারই নাম জানতে চাইছি!

ডালিমকুমার হাসতে হাসতে বলল দূর তুমি কিচ্ছু জান না, অন্য কোথাও আমার প্রাণ থাকলে আমি কি তা জানতে পারতাম না!

দুয়োরানি বলল তুমি তো লক্ষী ছেলে, সবকিছুই শোন! এখন আমার একটা কথা শুনবে?

ডালিম কুমার কি কথা, বড় মা?

দুয়োরানি তুমি তোমার মাকে জিজ্ঞাসা করবে, তোমার প্রাণ কোথায় রাখা আছে? দেখো আমার নাম আবার বলো না কিন্তু তাহলে তোমার মা বলবে না। তুমি এমনিই জানতে চাইবে তোমার মায়ের কাছে থেকে। তারপর তোমার মা কি বলল আমাকে জানাবে। যদি তুমি আমার এই কথা রাখ তবে তোমাকে তোমার পায়রা দেব।

ডালিম কুমার বলল আচ্ছা বড়মা, তাই হবে, তুমি একন আমার পায়রাটা দাও তো!

দুয়োরানি ডালিমকুমারের হাতে পায়রা দিয়ে বলল আমার কথা ভুলো না কিন্তু। ডালিম কুমার হাসতে হাসতে বলল তোমার কথা কি ভুলতে পারি বড় মা? এই বলে ডালিম কুমার পায়রা নিয়ে আবার যথাস্থানে ফিরে পায়রাদের সাথে খেলতে লাগল। খেলতে খেলতে ডালিম কুমার দুয়োরানির কথা ভুলে গেল, সেদিন রাতে আর মাকে কিছু জিজ্ঞাসা করা হলো না। পরদিন বিকেলে যথারীতি ডালিম কুমার পায়রাদের সাথে বাগানে খেলা করছিল, গতদিনের মত আজও একটি পায়রা উড়ে গিয়ে বসলো দুয়োরানির প্রাসাদে। দুয়োরানি খপ্‌ করে পায়রাটাকে ধরে নিল। ডালিম কুমার পায়রা চাইতে গেলে দুয়োরানি বলল কৈ, আমি যা জানতে চেয়েছিলাম জেনেছো?

ডালিম কুমার জিভ কেটে বলল একদম ভুলে গেছি বড়মা। তুমি আজকের মত আমার পায়রা দিয়ে দাও, কাল ঠিক মার কাছে থেকে জেনে আসব।

দুয়োরানি বলল ঠিক আছে, কিন্তু দেখবে কাল কিছুতেই যেন ভুল না হয়।

ডালিম কুমার হবে না আর।

দুয়োরানি কথা দিচ্ছ?

ডালিম কুমার কথা দিচ্ছি বড়মা। কাল ঠিকই বলবো তোমাকে, এ আর এমন কি ব্যাপার, তুমি এখন পায়রাটা দিয়ে দাও।

দুয়োরানি ডালিমকুমারের পায়রা ফিরিয়ে দিতে দিতে বলল মনে থাকে যেন। নয়তো আর পায়রা দেব না।

ডালিম কুমার সেদিন আর ভুলে না দুয়োরানির কথা। রাতে প্রাসাদে ফিরে সে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলল মা আমি একটা কথা জিজ্ঞাসা করব ঠিক ঠিক বলবে?

সুয়োরানি ছেলেকে বুকে ধরে বলল আমি কি কখনও তোমাকে ভুল বলেছি মানিক।

আচ্ছা মা আমার প্রাণ কোথায় আছে?


পৃষ্ঠা ৩



ডালিম কুমারের কথা শুনে সুয়োরানি আঁতকে উঠল, সর্বনাশ ছেলে কি বলে? কিন্তু নিজের মনে ভাব গোপন করে সে বলল ছিঃ বাবা তুমি এ কথাও জান না, সবার প্রাণ তো বুকের মধ্যিখানে থাকে, তোমার প্রানও সেখানেই আছে।

ডালিম কুমার না মা, আমি শুনেছি আমার প্রাণ নাকি বুকের মধ্যিখানে নেই। কোন এক সন্ন্যাসী নাকি তোমাকে বলে গেছে যে আমার প্রাণ কোথায় আছে?

সুয়োরানি বিপদের আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে বললেন তোমাকে কে বলেছে একথা?

ডালিম কুমার আমাকে কেউ বলেনি মা, আমি জানি আমার প্রাণ আমার বুকের মধ্যে নেই। তুমি বলো না মা, আমার প্রাণ কোথায় রাখা আছে।

সুয়োরানি এবার গম্ভীর কন্ঠে বলল বাজে কথা চিন্তা করে বৃথা সময় নষ্ট করো না, তোমাকে অনেক বড় হতে হবে। এই রাজ্যের ভার নিতে হবে।

ডালিম কুমারের মুখ মলিন হয়ে গেল, অভিমানী গলায় সে বলল তুমি আমাকে বলবে না তো, ঠিক আছে তোমার সাথে আমি আর কখনও কথা বলবো না, খাব না, পড়ব না, এই তোমাদের সবার সাথে আমার আড়ি।

মুখ কালো করে ডালিম কুমার তার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। রাতে অনেক ডাকাডাকি করেও খাওয়ানো গেল না, শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে সুয়োরানি ছেলেকে বলে দিল যে তার প্রাণ কোথায় আছে।

পরদিন ডালিমকুমার দুয়োরানির কাছে গিয়ে বলল জান বড়মা, তুমি ঠিকই বলেছিলে, আমার প্রাণ আমার বুকে নেই, আছে ঐ পুকুরের রাগববোয়ালের পেটে, চন্দনের কৌটার মধ্যে।

ব্যাস দুয়োরানির কেল্লাফতে, মনে মনে দুয়োরানি ভাবে, এবার তুমি কোথায় যাবে বাছা? এমন ফন্দি আঁটব কাকপক্ষী টের পাবে না। দুয়োরানি মনে মনে ফন্দি আঁটতে লাগল যে কিভাবে ডালিমকুমারের প্রাণনাশ করা যায়। একদিন তিনি তার পরিচারিকাকে দিয়ে দু বান্ডিল প্যাঁকটি (পাট খড়ি) আনালেন।

মাটিতে বিছানার মত প্যাঁকটি পেতে তাতে শুয়ে পড়ে পরিচারিকাকে বললেন যাও, মহারাজের কাছে গিয়ে বল যে রানিমার অসুখ হয়েছে।

অসুখের খবর পেয়ে মহারাজ হন্তদম্ভ হয়ে দুয়োরানির কাছে এসে বলল বড়রানি তোমার কি অসুখ হয়েছে? দুয়োরানি অসুস্থতার ভান করে বলল মহারাজ আপনি তো এখন ব্যস্ত, ডালিম কুমার আসার পর থেকে সুয়োরনিই আপনার সব, আমার কথা আপনার মনে পড়ে না? অসুখের কথা শুনে আমার কুটিরে যে আপনার পদধূলি পড়েছে, এটাই আমার পরম সৌভাগ্যে।

মহারাজ বিচলিত হয়ে বললেন একথা কেন বলছ বড় রানি, আমি কি তোমাকে অসুখী রেখেছি? তোমার কি রোগ হয়েছে?

দুয়োরানি ভণিতা করে চোখের জল মুছে বলল আমার দুর্ভাগ্য মহারাজ, নয়তো এমন রোগ শত্রুরও যেন না হয়। আমার সারা শরীরে হাড় মটমট করে ভেঙ্গে যাচ্ছে। অসহ্য যন্ত্রণা, পাশ ফিরলেই মনে হয় হাড়গোড় গুড়ো গুড়ো হয়ে যাচ্ছে। এই বলে রানি পাশ ফিরে শুলেন, সঙ্গে সঙ্গে চাদরের নিচে রাখা প্যাঁকাটিগুলো মটমট করে ভাঙছিল।


পৃষ্ঠা ৪


 

প্যাঁকাটি ভাঙ্গার শব্দে রাজা চমকে উঠলেন। মনে মনে ভাবলেন সত্যিই তো বড়রানির কঠিন রোগ হয়েছে। রাজা সঙ্গে সঙ্গে রাজবদ্যিকে ডেকে পাঠালেন। বড়রানির সাথে আগে থেকেই রাজবদ্যির পরামর্শ করা ছিল, বৃদ্ধ বদ্যিমশাই শাল জড়িয়ে মহারাজের সামনে উপস্থিত হলেন, মাথায় একটি চুলও নেই, এমনকি দাঁড়ি গোঁফ সম্পূর্ণ কামানো। রাজবদ্যি উপস্থিতি হলে মহারাজ একটা জলচৌকি আনিয়ে তাকে সেখানে আসল গ্রহন করতে বললেন। তারপর দুয়োরানির রোগের কথা তাকে বিস্তারিত জানালেন।

মহারাজের মুখে রানির রোগের বর্ণনা শুনে রাজবদ্যির ভ্রূকুঁচকে উঠল, তিনি গালে হাত বোলাতে লাগলেন, কিছুক্ষণ পর বললেন, মহারাজ বড় রানির ভয়ঙ্কর রোগ হয়েছে, সে রোগে আক্রান্ত হলে রোগীকে সুস্থ করে তোলা দুষ্কর। এ রোগের চিকিৎসা এই ভাবে সম্ভব নয়। আমাকে একবার বাড়ি যেতে দিন অথবা কাউকো পাঠিয়ে আমার বাড়ি থেকে চিকিৎসার বইগুলো আনিয়ে দিন।

মহারাজ ব্যস্ত কন্ঠে বলল না বদ্যিমশাই বাড়ি যাওয়া এখন হবে না, আমি লোক পাঠিয়ে আপনার যাবতীয় বইপত্তর আনিয়ে দিচ্ছি।

রাজবদ্যির খুশি দেখে কে, সে মনে মনে ভাবে পথ্য তৈরি করব না ছাই করব। এই সুযোগে রাজরাড়ির ভাল ভাল খাবারের সাথে মণ্ডামিঠাই খাওয়া তো যাবে। আর তাছাড়া বড় রানি তো আড়ালে আমাকে পুরস্কৃত করবেই।

প্রায় একঘন্টা পর রাজার অনুচর মাথায় করে নিয়ে এল একগাদা পুঁথি। রাজবদ্যি সেই পুঁথি থেকে একটা পুঁথি নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন আর মাঝে মাঝে সংস্কৃত শ্লোক আউড়াচ্ছেন। মহারাজের নির্দেশে দুয়োরানির দাসী দামী সুগন্ধী ধূপ আর প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখে গেল।

রাজবদ্যি একের পর এক পুঁথি ওল্টাচ্ছেন আর চিৎকার করে মন্ত্র পাঠ করছেন। এই ভাবে চলতে লাগল ঘন্টার পর ঘন্টা। এক সময় রাজবদ্যি তার মন্ত্র পাঠ থামিয়ে শঙ্কিত স্বরে বললেন মহারাজ এ রোগের নাম ‘হাড় মট মট’, শাস্ত্রে আছে এ রোগ যার হয় তাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুস্থ করে তোলা দরকার নয়তো প্রাণনাশ ঘটতে পারে।

রাজবদ্যির কথায় সকলে চমকে উঠলেন, মহারাজ ব্যস্ত হয়ে বললেন আপনি বলুন বদ্যিরাজ আমাকে কি করতে হবে, আমি এক্ষুনি তার যথাযথ ব্যবস্থা করছি।

মহারাজ এই রোগের একটাই মাত্র পথ্য আছে। তা হচ্ছে আপনার বাগানের সামনে যে জলাশয় আছে তার মধ্যে বাস করে একটি রাঘববোয়াল। ঐ বোয়াল মাছের পিণ্ড দিয়ে এক রকম তৈল তৈরী করে বড়রাণীর সারা গায়ে মালিশ করলে তবে বড় রানি সুস্থ হয়ে উঠবেন।

মহারাজ সঙ্গে সঙ্গে জেলেদের ডেকে পাঠিয়ে জলাশয় থেকে রাঘব বোয়াল ধরলেন। এই বোয়ালের পেটেই আছে ডালিমকুমারের প্রাণ।

বড় রানির প্রধান পরিচারিকা রাঘব বোয়ালের পেট চিরে চন্দনের কৌটো সংগ্রহ কররে আড়ালে বড় রানির হাতে তুলে দিলেন। আর এদিকে রাজবদ্যি এক বোতল সাধারণ তৈল মহারাজের হাতে দিয়ে বললেন, মহারাজ বড় রানিকে সুস্থ করে তোলার এই একমাত্র পথ্য।

মহারাজের চিন্তা দূর হল! মহারাজ রাজবদ্যিকে খুশী হয়ে একটি সোনার মোহর উপহার দিলেন।


পৃষ্ঠা ৫



তিন চার দিন পর দুয়োরানি খবর পাঠালেন তিনি সুস্থ হয়ে উঠছেন। এ খবর পেয়ে মহারাজ আবার পুরস্কৃত করলেন রাজবদ্যিকে। এদিকে দুয়োরানি প্রতিদিন গোপন স্থান থেকে চন্দনের কৌটো বের করে মনে মনে বলেন এবার তোমায় কে বাঁচায় দেখি? আমায় অনেক কষ্ট দিয়েছ, এখন আমি যখন ইচ্ছে তোমাকে মেরে ফেলতে পারি।

এইভাবে কেটে গেল আরো কয়েকটি মাস, একদিন দুয়োরানি সকাল বেলা গোপন স্থান থেকে চন্দনের কৌটো এনে মুখ খুলে সেই সোনার হারটি হাতে নিলেন। এদিকে ডালিমকুমারকে বসিয়ে সুয়োরানি খাবার খাওয়াচ্ছিল, হঠাৎ ডালিমকুমার খাওয়া বন্ধ করে বিমর্ষ কন্ঠে বলল মা আমার শরীরটা ভাল লাগছে না। রাজপুত্রের কথায় সুয়োরানি চমকে উঠলো, তার নয়নের মণি এ কি বলছে, ছেলেকে সুয়োরানি বুকে টেনে নিয়ে ব্যস্ত স্বরে বললেন তোমার কি হয়েছে সোনা?

এদিকে দুয়োরানি সোনার হারটা এবার নিজের গলায় পরে নিলেন, সঙ্গে সঙ্গে ডালিমকুমার মায়ের কোলে ঢলে পড়ল। সুয়োরানি বুক চাপড়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। মহারাজের কানে খবর যাওয়া মাত্র মহারাজ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। ডালিমকুমারের এই অবস্থা দেখে মুষড়ে পড়লেন মহারাজ। ডেকে পাঠালেন রাজবদ্যিকে, রাজবদ্যি অনেকক্ষণ নাড়ী দেখে পরীক্ষা করে বিমর্ষ কন্ঠে বলল মহারাজ ডালিমকুমার আর বেঁচে নেই, এই বলে বদ্যিরাজ দু’হাতে মুখ ঢেকে কান্নার অভিনয় করতে লাগলেন।

সুয়োরানি পুত্রশোকে পাগলের মত হয়ে গেলেন। মহারাজ নিভৃতে একাকী বসে পুত্রশোকে চোখের জল ফেলছেন আর ভাবছেন কেমন করে এমন ঘটনা ঘটলো। ডালিমকুমারের মৃত্যুতে মহারাজের মনে সংশয় দেখা দিল। তিনি ডালিম কুমারের মৃতদেহ না পুড়িয়ে রাজ্যের শেষ প্রান্তে মহারাজের বিশ্রামের জন্য যে সুন্দর প্রাসাদ বানিয়েছিলেন সেই প্রাসাদেরই সুসজ্জিত একটি ঘরে ডালিম কুমারকে রত্ন খচিত পোশাকে আচ্ছাদিত করে শুইয়ে দিলেন, আর সঙ্গে প্রচুর খাদ্য, পর্যাপ্ত পোষাক সেই ঘরে মজুত করে রাখলেন।

সিংহদরজার বাইরে প্রহরীদের নির্দেশ দিলেন রাজার অনুমতি ছাড়া কোন পুরুষ যেন সেই প্রাসাদে প্রবেশ করতে না পারে। মহারাজ চোখের জল মুছতে মুছতে ডালিমকুমারের ঘর তালাবদ্ধ করে রাজপ্রাসাদে ফিরে এলেন।

ডালিম কুমারের প্রিয় সঙ্গী ছিল প্রধানমন্ত্রীর পুত্র। অকালে প্রিয় বন্ধুকে হারিয়ে সে খুবই বিচলিত হয়ে পড়ে। মন্ত্রিপুত্র একদিন মহারাজের সাথে দেখা করে কাঁদতে কাঁদতে বলল মহারাজ আমি এখন সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়েছি। রাজকুমারের অকাল মৃত্যুতে সঙ্গীহীন হয়ে আমার এখন সময় কাঁটতে চাইছে না। অনুগ্রহ করে আপনি যদি আমাকে আপনার বাগান বাড়িতে ডালিম কুমারের পাশে কয়েক মুহুর্ত কাটাবার অনুমতি দেন তবে নিদ্রায় মগ্ন বন্ধুর সাথে নিভৃতে কিছুটা সময় কাটাতে পারব।

মন্ত্রীপুত্রের কাতর অনুরোধ মহারাজ ফেলতে পারলেন না। মন্ত্রীপুত্রের হাতে ডালিমকুমারের ঘরের চাবি তুলে দিয়ে বললেন, প্রতিদিন যেন একবারের বেশি ডালিম কুমারের ঘরে না যায়।


পৃষ্ঠা ৬



এদিকে একমাত্র সন্তানের দুঃখে সুয়োরানি খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিলেন। রাজপ্রাসাদের এক কোণে সারাদিন চোখের জল ফেলেন আর ডালিম কুমারের কথা ভাবেন, কারো সাথে দেখা করেন না। এই অবস্থায় সুয়োরানির মনেও কোন শান্তি নেই। মহারাজ এরপর থেকে অবসর মুহুর্ত কাটাতে লাগলেন দুয়োরানির প্রাসাদে।

দুয়োরানি তো এটাই চাইছিল, তার মনোবাসনা পূর্ণ হয়েছে। তবে দুয়োরানি সারাদিন হার পড়ে থাকলেও রাত্রিবেলা সেই হার খুলে ফেলতেন, পাছে যদি মহারাজের নজরে পড়ে, মহারাজের মনে কোনরকম সন্দেহের উদ্ভব হয় সেই জন্য।

এদিকে দুয়োরানি যখন গলার হার খুলে বসতেন ডালিম কুমারের দেহে তখন প্রাণ ফিরে আসত। আবার গলার পড়লে ডালিম কুমারের মৃত্যু হত।

প্রথম প্রথম দুয়োরানি বেশ কিছুদিন গলার হার খুলতো না, কিন্তু যখন দেখল মহারাজের সামনে এ হার পরে থাকা বিপদ তখন থেকে রাত্রিবেলা হার খুলে ফেলতো। যেমন দুয়োরানি প্রথমবার যখন তার গলা থেকে হারটি খুলে ফেলল ঠিক তখনিই ডালিম কুমার জেগে উঠল, সে দেখতে পেল তাকে একটি সজ্জিত ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছে। প্রচণ্ড ক্ষিদে তৃষ্ণায় ডালিম কুমার ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। শয্যার পাশে পর্যাপ্ত খাবার দেখে ডালিম কুমার গোগ্রাসে খাবার খেতে লাগল। তাতে করে ডালিম কুমারের শরীরে বল ফিরে এল। চারিদিকে ঘুরে সে বুঝতে পারল এই বাগান বাড়ি তাদেরই, তবে এখানে সে কেমন করে এল তা বুঝতে পারছিল না? তার মা বাবাই বা কোথায়, তাও সে ভাবল?

ডালিম কুমার বাগানবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু এত উঁচু ইটের গাথুনি পেরিয়ে এই বাগানবাড়ি থেকে মুক্ত হওয়া তার সাধ্য ছিল না। তবে ডালিম কুমার এটা বুঝতে পারল তার এই পরিণতির জন্য দায়ী দুয়োরানি, একমাত্র দুয়োরানির চক্রান্তই তাকে রাজবাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।

বাগানে দাঁড়িয়ে ডালিমকুমার প্রাণপণে চিৎকার করতে লাগল, কিন্তু কে শুনবে তার চিৎকার! বাগান বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে কোন জনবসতি ছিল না, এক সময় ক্লান্ত হয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে আবার সে তার শয্যায় শুয়ে পড়ে। এদিকে রাতের অন্ধকার কেটে আকাশ ফর্সা হয়ে উঠেছে, মহারাজ দুয়োরানির প্রাসাদ ত্যাগ করে নিজ প্রাসাদে ফিরে এলেন। মহারাজ চলে যেতেই দুয়োরানি গোপন স্থান থেকে হার নিয়ে আবার গলায় পড়লেন। আর সঙ্গে সঙ্গে ডালিমকুমার বাগানবাড়িতে মারা গেল।

এইভাবে দিনের পর দিন চলতে লাগল। ডালিম কুমারের দেহ মধ্যরাতে প্রাণ ফিরে পেত, আবার ভোর হওয়ার পূর্বেই মারা যেত। মন্ত্রিপুত্র প্রতিদিনই দিনের বেলা বন্ধুর শয্যার পাশে বসে নীরবে চোখের জল ফেলে বিদায় নিত।


পৃষ্ঠা ৭


 

মন্ত্রীপুত্রের মনে কেমন যেন সন্দেহ হল, কতদিন হল রাজপুত্র মারা গেছে, অথচ তার দেহের কোন পরিবর্তন হচ্ছে না। যে শয্যায় ডালিম কুমার শায়িত তা দেখে কখনো মনে হয় না সে মৃত, পচনের কোন লক্ষণ নেই। তাছাড়া শয্যার পাশে যেসব খাবার রাখা হয়েছে, সেগুলোর কিছু কিছু খাওয়া হয়েছে এবং সেগুলোর অবশিষ্টাংশ এখনো পড়ে আছে। বুদ্ধিমান মন্ত্রিপুত্র কিন্তু এ ঘটনা কাউকো জানাল না, এমনকি মহারাজের কাছেও বেমালুম চেপে গেল। ব্যাপারটা মন্ত্রিপুত্র স্বচক্ষে দেখতে চায়।

একদিন গভীর রাতে মন্ত্রী পুত্র নিঃশব্দে বাগানবাড়িতে প্রবেশ করল। ডালিমকুমার তখন দেহে প্রাণ ফিরে পেয়েছিল আর সে ঘরের মধ্যে পায়চারী করছিল। মন্ত্রিপুত্র সন্তর্পণে ঘরের দরজায় কান পাততেই চমকে উঠল, কে যেন ঘরের মধ্যে পায়চারী করছে। অন্য কোন মানুষ হলে হয়তো তৎক্ষণাৎ ভূত ভেবে অক্কা পেত। কিন্তু মন্ত্রিপুত্র ছিল যেমন ভীষণ সাহসী তেমনি বুদ্ধিমান। ভয় কাকে বলে জানে না সে, দরজার ফাঁকা অংশে চোখ রাখতেই সে দেখতে পেলো, তার প্রিয় বন্ধু ডালিম কুমার ঘরময় পায়চারী করছে। এক মুহুর্তের জন্য চমকে উঠলেও নিজেকে সামলে নিল মন্ত্রিপুত্র। তারপর দরজায় মৃদু আঘাত করে ডাকতে লাগল। ডালিমকুমার, ডালিমকুমার।

নিজের নাম শোনা মাত্রই ডালিম কুমার পায়চারী বন্ধ করল, এরপর বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞাসা করল কে?

আমি, আমি মন্ত্রিপুত্র।

মন্ত্রিপুত্র! শোনা মাত্রই ডলিম কুমার দরজা খুলে দিল। প্রায় দু’বছর ডালিম কুমার একাকী কাটিয়ে হাঁফিয়ে উঠেছিল। এতদিন পর প্রিয় বন্ধুকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগল। একসময় দুই বন্ধু শয্যার পাশে আসন গ্রহণ করল।

মন্ত্রিপুত্রের তখন মনে হচ্ছিল সে জেগে নেই। নিজের গায়ে চিমটি কেটে ঘুমিয়ে আছে না জেগে আছে তা একটুখানি পরখ করে নিলো সে। একসময় মন্ত্রিপুত্র ডালিমকুমারকে জিজ্ঞাসা করল কি ভাবে এমন ঘটনা ঘটল?

ডালিম কুমার প্রথম থেকে সব ঘটনা তাকে খুলে বলল দুয়োরানির কথা, তার প্রাণ, সেই সোনার হারের কথা সবকিছুই বলল মন্ত্রিপুত্রকে। সব শুনে মন্ত্রিপুত্র বুঝলো এসবই দুয়োরানির কারসাজি। দুয়োরানি যেভাবেই হোক সেই সোনার হার হাত করেছে। মন্ত্রিপুত্র ডালিম কুমারকে আশ্বস্ত করে সেদিনকার মত বাগান বাড়ি পরিত্যাগ করল। এদিকে ভোর হওয়ার সাথে সাথে দুয়োরানি যখন সোনার হার গলায় দিল, ডালিম কুমার তখন আবার মারা গেল।

সেদিনের পর থেকে মন্ত্রিপুত্র দুয়োরানিকে চোখে চোখে রাখত। প্রতিদিন মন্ত্রিপুত্র দেখতে পায় দিনের বেলা দুয়োরানি এক গাছা সোনার হার পরে থাকে আবার রাত হলে খুলে রাখে। যেভাবেই হোক দুয়োরানির কাছ থেকে সোনার হারটি হাতাতে হবে। কিন্তু তার কাছ থেকে হার হাতানো এত সহজ বিষয় নয়। হার হাতানোর সেরকম কোন সুযোগই পাওয়া যাচ্ছে না। মন্ত্রিপুত্র সেদিনের পর থেকে প্রতিদিন রাতে ডালিমকুমারের সাথে মিলিত হয়, দুই বন্ধু অনেক সুখদুঃখের গল্প করে, আবার ভোর হওয়ার পূর্বে বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মন্ত্রিপুত্র নিজ মহলে ফিরে আসে।


পৃষ্ঠা ৮



এইভাবে কেটে গেল আর তিনটে বছর।

স্বর্গলোকে ভাগ্যদেবতার এক বোন ছিল। বোনের এক কন্যাসন্তান হয়। সন্তান হবার পর বোন তার নবজন্ম শিশুকে, দাদা ভাগ্যদেবতার ঘরে রেখে আসে। কারণ ভাগ্যদেবতাই তো সকলের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়। এ রীতি তো যুগযুগান্তর ধরে চলে আসছে। আতুড় ঘরে মা তার নবজাত শিশুর পাশে কালি আর কলম রেখে ঘরের বাইরে আসে। সেই সুযোগে ভাগ্যদেবতা শিশুটির ভাগ্য নির্ধারণ করে। ভাগ্যদেবতার বোনও দাদার কাছে তার কন্যাসন্তানকে রেখে খানিক বাদে এসে ভাগ্য দেবতাকে জিজ্ঞাসা করে, দাদা আমার মেয়ের ভাগ্যে কি লিখেছো? ভাগ্যদেবতা কখনও কাউকে আগে থেকে ভাগ্য বলেন না। কিন্তু তার একমাত্র বোন নাছোড়বান্দা, তাই বাধ্য হয়ে তিনি বোনকে বললেন

ধরা কন্যে মৃত বর

অনাথ মন্দিরে তার ঘর।

এ কথা শুনে ভাগ্যদেবতার বোন চিৎকার করে কাঁদতে লাগল আর বলতে লাগল দাদা তুমি এ কি করলে? আমার একমাত্র মেয়ের কপালে এ তুমি কি লিখলে? না না! তুমি অন্য কিছু লেখ।

বোনের কান্না শুনে ভাগ্যদেবতা রুষ্ট হয়ে বললেন তুমি তো জান আমার কলমের কালি একবার পড়ে গেলে, কখনও তার পরিবর্তন হয় না।

অগত্যা ভাগ্যদেবতার বোন আর কি করেন, ভাগ্যের দোহাই দিয়ে একমাত্র কন্যাকে মনের মত গড়ে তোলায় নিমগ্ন হলেন। এইভাবে কেটে গেল অনেকগুলো বছর। ভাগ্যদেবতার বোনের মেয়ে এখন আর সেই শিশুটি নেই, ক্রমে ক্রমে বিয়ের উপযুক্ত হয়ে উঠেছে, দিন যতই যায় ভাগ্যদেবতার বোন মেয়ের ভবিষ্যৎ এর কথা চিন্তা করে শঙ্কিত হয়ে ওঠেন। মনে মনে সংকল্প করেন যে ভাবেই হোক এই দুর্ভাগ্যখন্ডাতে হবে। দাদাকে পরিত্যাগ করে ভাগ্য দেবতার বোন কন্যাকে নিয়ে নানান দেশ ঘুরতে ঘুরতে হাজির হলেন ডালিমকুমারের বাগান বাড়ির সমানে। পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে মেয়ে তার মাকে বলল মা আমার খুব জলতেষ্টা পেয়েছে। কাপড়ের আঁচল দিয়ে মেয়ের কপালের ঘাম মুছে মা বলল তুই তাহলে এখানেই অপেক্ষা কর, আমি জল নিয়ে আসি।

একমাত্র কন্যা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতে মা চলে গেল জল আনতে।

চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল ভাগ্যদেবতার বোনের মেয়ে, কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে?

সেই কখন তার মা জল আনতে গেছে, ফিরে আসার কোন নামগন্ধ নেই। সামনে সুসজ্জিত বাগান দেখে তার মনে বাগান দেখার লোভ জাগলো, ধীর পায়ে লোহার গেট ঠেলে বাগানে প্রবেশ করল মেয়েটি। চারদিকে রং-বেরংয়ের ফুলের বাহার দেখে তার মন খুশিতে ভরে উঠল। বাগানের কিছুটা পথ অতিক্রম করতেই দেখতে পেল একটি সুন্দর প্রাসাদ। প্রাসাদের একটি ঘর থেকে আলো ঠিকরে বাইরে আসছে। কৌতুহলী হয়ে ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই চমকে উঠল সে। দেখল, সুসজ্জিত ঘরে বসে রূপবান এক যুবক মিঠাই খাচ্ছে।


পৃষ্ঠা ৯



ডালিমকুমারও অবাক হয়ে গেল, মেয়েটির রূপে মুগ্ধ হয়ে বিস্মিত কন্ঠে তাকে জিজ্ঞাসা করল কে তুমি? এত রাতে এখানে এলে কি করে?

মেয়েটির মুখেও হাসি ফুটে উঠল, মৃদু কন্ঠে সে ডালিম কুমারকে বলল আগে বল তুমি কে?

ডালিম কুমার আমি রাজপুত্র ডালিম কুমার, আর তুমি?

মেয়েটি আমি ভাগ্যদেবতার ভাগ্নী। এই বলে সে সমস্ত ঘটনা ডালিম কুমারকে খুলে বলল, তার মামা ভাগ্যদেবতা তার কপালে লিখে দিয়েছেন, ধরো কন্যে, মৃত বর, অনাথ মন্দিরে তার ঘর।

সব শুনে ডালিম কুমারের মন আনন্দে ভরে উঠল, সে তখন তার জীবন কাহিনী বলল, দুয়োরানির কথা বলল, শেষে বলল দেখ, আমার মনে হয় ভাগ্যদেবতা তোমার ভাগ্যে যে মৃত বরের কথা বলেছেন সেটা মনে হয় আমিই। আর সেকারণেই ভাগ্য তোমাকে এখানে আমার সাথে সাক্ষাত করে দিয়েছে। এই আমিই তোমার মৃত স্বামী আর এই প্রাসাদ অনাথ আশ্রমের সামিল, তুমি আমাকে বিয়ে কর।

এমন সময় সেই ঘরে প্রবেশ করল মন্ত্রিপুত্র, পরমা সুন্দরী একটি মেয়েকে দেখে অবাক হয়ে বন্ধুর কাছে তার পরিচয় জানতে চাইল। ডালিম কুমার তখন মন্ত্রিপুত্রকে সব খুলে বলল। সব শুনে মন্ত্রিপুত্র মেয়েটিকে বলল ডালিম কুমার ঠিকই বলেছে, বিধাতা তোমার স্বামী হিসেবে ডালিম কুমারকেই নির্বাচন করেছে, তুমি আর অমত করো না, আমি এক্ষুনি তোমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করছি।

কিন্তু পুরোহিত নেই, মন্ত্র পাঠ করবে কে? মন্ত্র পাঠ ছাড়া বিয়ে হয় নাকি?

মন্ত্রিপুত্র বলল শাস্ত্রে আছে, পরস্পর পরস্পরের মতামত এবং বর কনের মালা বদলের মাধ্যমে গান্ধর্ব মতে বিয়ে করা যায়। সুন্দরী কন্যা আর আপত্তি করল না। মন্ত্রিপুত্র বাগান থেকে ফুল সংগ্রহ করে সেই ফুল দিয়ে মনের মত দুটো মালা গাঁথলো। তারপর মেয়েটির হাতে দিয়ে বলল কন্যে এই মালা তুমি ডালিম কুমারের গলায় পরিয়ে দাও। আর অন্য মালাটি ডালিম কুমারের হাতে তুলে দিয়ে বলল তুমি এটা এই কন্যাকে পরিয়ে দাও। মালা বদল হয়ে গেলে সবাই হাসি ঠাট্টা গল্পে মেতে উঠল, এই ভাবে এক সময় ভোর হয়ে গেল, মন্ত্রিপুত্র বিদায় নিয়ে চলে গেল, আর ডালিম কুমারও আবার মরে গেল, সুন্দরী কন্যা তখন হায় হায় করে কাঁদতে লাগল।

প্রতিদিন রাতে ডালিম কুমার দেহে প্রাণ ফিরে পেত, তখন সে ভাগ্য দেবতা ভাগ্নীর সাথে ঘর করত। আবার ভোর হওয়ার আগেই ডালিম কুমার মারা যেত। তখন ডালিম কুমারের বউ একা একা সেই প্রাসাদে দিন কাটাত। দেখতে দেখতে এই ভাবে প্রায় ছয় সাত বছর কেটে গেল। ডালিম কুমার দুই সন্তানের জনক হল আর তার পুত্রদ্বয় বাবার মতই রূপবান হল। তাদের মুখের দিকে তাকালে প্রাণ জুড়িয়ে যায়।


পৃষ্ঠা ১০



ক্রমে ক্রমে ডালিম কুমারের বড়পুত্র চার বছরে পদার্পণ করল, আর ছোটটির বয়স হল দুই। এমনি একদিন রাতে ডালিম কুমারের বউ চোখের জল ফেলতে ফেলতে স্বামীকে এবং মন্ত্রিপুত্রকে বলল এমনভাবে কতদিন আমরা কাটাব? এই অজ্ঞাতবাস আমার আর ভাল লাগছে না।

বিমর্ষ স্বরে মন্ত্রিপুত্র বলল— কি করবে বল? বিধাতার লিখন কি খণ্ডন করা যায়? 

ডালিম কুমারের বউ হঠাৎ চিন্তান্বিত হয়ে বলল আমি একটা পথ ভেবেছি, যেন তেন প্রকারে যদি দুয়োরানির কাছ থেকে ঐ হারটি সংগ্রহ করতে পারি তবে আর আমাদের এত কষ্ট করতে হবে না।

ডালিম কুমার গালে হাত দিয়ে বলল তা তো জানি কিন্তু ঐ রাক্ষসীর কাছ থেকে হার সংগ্রহ করা যায় কি ভাবে?

ডালিম কুমারের স্ত্রী বলল সে দ্বায়িত্ব আমার, তোমরা সেটি আমার উপর ছেড়ে দাও, শুধু আমার কয়েকটা জিনিস দরকার। তোমরা সেগুলো এনে দেওয়ার ব্যবস্থা কর।

মন্ত্রিপুত্র বলল কি জিনিস সেগুলো?

ডালিম কুমারের স্ত্রী বলল— নাপতিনীদের যে যে জিনিসের প্রয়োজন হয় আমাকে সেই সব জিনিস আনিয়ে দাও।

এরপর ডালিম কুমারের স্ত্রী সেই জিনিসগুলো পেয়ে নাপতিনী সেজে দুই ছেলেকে নিয়ে হাজির হলেন সুয়োরানির প্রাসাদে। তারপর চিৎকার করে বললেন রানিমা আলতা পরবেন?

নাপতিনীর চিৎকারে সুয়োরানি বাইরে এসে নাপতিনীর সাথে দুটো রূপবান শিশুকে দেখতে পেলেন। শিশু দুটিকে দেখে তার প্রাণ জুড়িয়ে গেল। কাছে এসে দুটি শিশুকে কোলে টেনে নিয়ে বলল ভারী সুন্দর তোমার ছেলেরা গো, ঠিক যেমনটি ছিল ছোটবেলায় আমার একমাত্র নয়নের মণি।

ডালিম কুমারের স্ত্রী নাপতিনী অবাক হওয়ার ভান করে বলল কেন মা! আপনার নয়নের মণির কি হয়েছে?

কাঁদতে কাঁদতে সুয়োরানি বলল সে আর বলো না, কোল খালি করে চিরদিনের জন্য চলে গেল, অনেক দুঃখের কাহিনী, সে যাই হোক তুমি বাপু মাঝে মাঝে তোমার ছেলে দুটোকে আমার কাছে নিয়ে এস। এই বলে সুয়োরানি ডালিম কুমাররের দুই পুত্রের হাতে দুটো মোহর দিলেন।

ডালিম কুমারের স্ত্রী জিজ্ঞাসা করল রানিমা আলতা পরবেন না?

সুয়োরানি না বাপু, সে সব শখ আর নেই, তুবে তুমি ছেলেদুটোকে নিয়ে মাঝে মাঝে এসো কিন্তু।

এরপর নাপতিনী গেল দুয়োরানির প্রাসাদে। বলল ‘আলতা পরবেন না কি?’

আলতা! দুয়োরানি প্রাসাদ ছেড়ে বাইরে এসে দেখল অপূর্ব সুন্দরী দেখতে একটি মেয়ে আলতা পরাতে এসেছে। দুয়োরানি আবার যার তার কাছে আলতা পরাতে ভালবাসেন না। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নাপতিনী দেখে দুয়োরানি আলতা পরতে বসলেন। ছদ্মবেশী ডালিম কুমারের স্ত্রী সযত্নে দুয়োরানির পা পরিষ্কার করে দিল, দুয়োরানি এত ভাল নাপতিনী এর আগে কখনও দেখেননি, মনে মনে তার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে দুয়োরানি বললেন তুমি একদিন অন্তর একদিন আসবে, আমি তোমার কাজে খুব খুশি।


পৃষ্ঠা ১১



ছদ্মবেশী ডালিম কুমারের স্ত্রী বিদায় নেওয়ার সময় আড়চোখে দুয়োরানির গলার সোনার হার ছড়াটি লক্ষ্য করল, মনে মনে ভাবল, যেভাবেই হোক ঐ হার ছড়া তাকে সংগ্রহ করতেই হবে।

ছদ্মবেশী ডালিম কুমারের স্ত্রী বিদায় নেওয়ার সময় আড়চোখে দুয়োরানির গলার সোনার হার ছড়াটি লক্ষ্য করল, মনে মনে ভাবল, যেভাবেই হোক ঐ হার ছড়া তাকে সংগ্রহ করতেই হবে।

বাগান বাড়িতে ডালিম কুমারের স্ত্রী ডালিম কুমারকে এবং মন্ত্রিপুত্রকে প্রথমদিনের অভিজ্ঞতার কথা বলল আর কিভাবে সেই হার সংগ্রহ করবে তার ফন্দি আঁটতে লাগল। একদিন পর আবার ছদ্মবেশী ডালিম কুমারের স্ত্রী দুয়োরানির প্রাসাদে হাজির হল, সেদিন সঙ্গে তার ছোট ছেলেটিকে নিয়ে গিয়েছিল। দুয়োরানি আলতা পরতে পরতে বলল হ্যাঁ গো নাপতিনী, তোমার বড় ছেলেটিকে যে দেখছি না?

নাপতিনী আর বলবেন না রানিমা ভীষণ দুরন্ত হয়ে উঠেচে, যখন যা চাইবে তাই দিতে হবে, ভুলিয়ে বাড়িতে রেখে এসেছি।

দুয়োরানি প্রশ্রয়ের হাসি হেসে বলল তা হোক ছোট ছেলে একটু চাইবে, বাড়িতে একা রেকে এসেছিস, এরপর থেকে নিয়ে আসিস।

দুয়োরানির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সুয়োরানির কাছে গেল ডালিম কুমারের স্ত্রী। মনে মনে ভাবল শ্বাশুড়ীর আশীর্বাদ যে তার একান্ত দরকার, তা না হলে এতবড় দ্বায়িত্ব সে পালন করবে কি করে? সুয়োরানির আশীর্বাদ নিয়ে ডালিম কুমারের স্ত্রী আবার বাড়ি ফিরে এল।

একদিন পর ডালিম কুমারের স্ত্রী তার বড় ছেলেকে বলল বাবা, আজ রানিমার গলার সোনার হারটি নেয়ার বায়না করবি, যতক্ষণ তোকে হার না দেবে, ততক্ষণ তুই চিৎকার করে কাঁদবি। বড় পুত্রকে ভাল করে শিখিয়ে পড়িয়ে ডালিমকুমারের স্ত্রী দুয়োরানিকে আলতা পরাতে গেল।

আলতা পরাতে পরাতে প্রায় বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে এল, বিদায় নেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো ডালিম কুমারের স্ত্রী। অমনি বড় পুত্র রানিমার গলার হারটি নেওয়ার বায়না ধরল।

নাপতিনী কপট রাগ দেখিয়ে বলল ও কি বলছ বাবা! ওর অনেক দাম, হাত দিতে নেই।

বড় পুত্র না মা আমি দেখব ও হার, এই বলে বড় পুত্রটি কাঁদতে লাগল।

দুয়োরানি ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে নাপতিনীকে জিজ্ঞাসা করল কি গো তোমার ছেলে কি চাইছে?

নাপতিনী আর বলবেন না রানিমা, এই জন্য আমি ওকে কোথাও নিয়ে যাই না। ও এখন আপনার ঐ হারটা দেখতে চায়, এমন দস্যি ছেলে আর দেখিনি।

দুয়োরানি বলল ও এই ব্যাপার, তা দেখুক না হারটা, এই বলে দুয়োরানি গলার হার খুলে বড় ছেলেটার হাতে দিল।

বড় ছেলে হারটা নিয়ে নড়াচড়া করতে লাগল, একসময় নাপতিনী বলল বাবা, অনেক তো দেখলে এবার রানিমার হার রানিমাকে দিয়ে দাও, আমরা বাড়ি যাব।


পৃষ্ঠা ১২



বড় ছেলে বায়না করে বলল না মা আমি হার নে। দুয়োরানি এবার চোখ বড় বড় করে বলল না না! ঐ হার আমি কাউকো দেব না, তোমাকে অন্য হার দিচ্ছি।

বড় ছেলে না, আমি এই হারটাই নেব।

নাপতিনী কপট রাগ করে বলল দস্যি ছেলে দিয়ে দাও রানিমার হার।

 না আমি দেব না, এই বলে বড় ছেলে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল, সে কি কান্না, চোখ মুখ লাল হয়ে গেল।

নাপতিনী এবার কাঁদো কাঁদো গলায় বলল এই জন্যে আমি দস্যি ছেলে নিয়ে আসি না, এখন আমি কি করি রানিমা?

রানিমা বলল না বাপু, ঐ হার আমি কাউকো দিতে পারব না, তুমি বরং ছেলের জন্য অন্য হার নিয়ে যাও।

নাপতিনী বড় ছেলের কাছ থেকে হার কেড়ে নিতে গেলে সঙ্গে সঙ্গে বড় ছেলে আরো চিৎকার করে কেঁদে উঠল। তখন নাপতিনী রানিমার কাছে হাত জোড় করে বলল রানিমা, এখন হার কেড়ে নিতে গেলে একটা দক্ষযজ্ঞ বেঁধে যাবে, এর চেয়ে বরং রাতে সে যখন ঘুমিয়ে পড়বে তখন আপনার হার আমি ফেরৎ দিয়ে যাব।

নাপতিনী দুয়োরানিকে আশ্বস্ত করে আনন্দে নাচতে নাচতে বাগান বাড়িতে ফিরে এল। ডালিমকুমার তখন জেগেই ছিল। ডালিম কুমারের স্ত্রী স্বামীর হাতে তারপ্রাণ সেই হারছড়া তুলো দিল। মন্ত্রিপুত্রসহ সবাই ডালিম কুমারের স্ত্রীর প্রশংসা করতে লাগল।

মন্ত্রিপুত্র পরদিন মহারাজার কাছে বিস্তারিত সব ঘটনা খুলে বলল। সে বলল কিভাবে ডালিম কুমার এখনো বেঁচে আছে। একথা শুনে মহারাজ ভাবল মন্ত্রিপুত্র নিশ্চয়ই বন্ধুবিরহে পাগল হয়ে গেছে। কিন্তু মন্ত্রিপুত্র প্রথম থেকে সব ঘটনা খুলে বলায় মহারাজ অনেকটা আশ্বস্ত হলেন। তখন মহারাজের আনন্দ দেখে কে! একমাত্র পুত্রের মৃত্যুতে যিনি বিহবল হয়ে পড়েছিলেন, হঠাৎ পুত্রের এভাবে জীবিত থাকার খবর শুনে নতুন করে আবার তার মনে আনন্দের জোয়ার দেখা গেল। রাজপুত্র ও পুত্রবধূকে ফিরিয়ে আনার জন্য সুসজ্জিত সোনার রথ অপরূপ সাজে সজ্জিত হাতি আর ঘোড়া নিয়ে মহারাজ চললেন বাগানবাড়ির উদ্দেশ্যে। মহারাজ সবার আগে চলেছেন। বাগান বাড়িতে উপস্থিত হলে রাজপুত্র ডালিম কুমার এবং তার স্ত্রী বাবার পায়ে হাত রেখে প্রণাম করলো। মহারাজ হারানো ছেলেকে ফিরে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। তারপর সবাই মিলে রাজপ্রাসাদে ফিরে এলেন।

সুয়োরানি তার মৃত পুত্র ফিরে আসছে শুনে রাজপ্রাসাদের প্রধান দরজার সামনে ফুলের ডালি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। হারানো পুত্রকে ফিরে পেয়ে সুয়োরানি একমাত্র সন্তানকে বুকে টেনে আদরে আদরে ভরিয়ে দিলেন।

এদিকে দুয়োরানি প্রাসাদের বসেই সমস্ত ঘটনা জানতে পেরে হায় হায় করে উঠল, মহারাজ তো এবার তাকে ছাড়বে না, কথায় আছে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে


পৃষ্ঠা ১৩


 

মহারাজ দুয়োরানিকে রাজসভায় ডেকে নিয়ে এলেন। দ্বিতীয় অপরাধী সেই রাজবদ্যি কিন্তু সে আর পৃথিবীতে বেঁচে নেই। তৃতীয় অপরাধী দাসীকে রাজসভায় উপস্থিত করে মহারাজ উপস্থিত প্রজাদের কাছে সমস্ত ঘটনা বললেন। এরপর অপরাধীদের কি শাস্তি দেয়া উচিৎ এটি জানতে চাইলে উপস্থিত জনতা ক্রুদ্ধ স্বরে বলে উঠল, হেন পাপিষ্ঠের জ্যান্ত কবর দেওয়া উচিত।

অপরাধীদের বিচারের জন্য মহারাজ তার বাগানে একটি বিরাট গর্ত খুড়লেন। দুয়োরানি এবং তার প্রধান দাসীকে গর্তের মধ্যে ফেলে মাটি চাপা দেওয়া হল। তারপর মহারাজ উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে বললেন অন্যায় অবিচারের শাস্তি পেতেই হবে তা সে যত রাজমহলেই বাস করুক না কেন, যত উচ্চ বংশের মানুষই হোক না কেন, এগুলো বিবেচনাযোগ্য বিষয় নয়।

তারপরের ঘটনা সবার জানামহারাজ, রানি মা, একমাত্র পুত্র, পুত্রবধূ কুলবতী এবং দুই নাতিকে নিয়ে রাজপরিবারের সদস্যবৃন্দ সুখে শান্তিতে বাকি জীবন কাটাতে লাগল।


***** সমাপ্ত *****

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post