সারমর্ম: শারিরিকভাবে দুর্বল মানুষের বুদ্ধি ও সাহস থাকলেই কি তার পক্ষে সবকিছু করা সম্ভব? জানতে হলে পড়ুন পুরো গল্পটি । মোট-৬ পৃষ্ঠা
একগ্রামে এক অন্ধ আর এক কুঁজো পাশাপাশি বাড়িতে বাস
করত। অন্ধ ব্যক্তিটি দু’চোখেই অন্ধ ছিল ফলে সে কিছুই দেখতে
পেত না। একদিন অন্ধর মা বলল― বাবা তোর কাকার বাড়ি থেকে এক বাটি
দুধ এনে দিবি? সারাদিন উপোসের পর একটু দুধ খেতে পারলে শরীরটা সুস্থ হত। অন্ধ বলল— আমি কি করে যাব মা? আমি তো একা একা চলতেই পারি না।
ছেলের কথা শুনে মা ভীষণ রেগে গিয়ে ছেলের গালে ঠাস
করে একটা চড় মেরে বলল― তা পারবি কেন? কাজ করতে আসলেই
তোর যত অসুবিধা, এমন ছেলে থাকার চেয়ে না থাকা অনেক ভাল! এই বলে অন্ধের মা গজরাতে গজরাতে
স্থানত্যাগ করল। মনের দুঃখে অন্ধ ভাবল এ বাড়িতে থেকে লাভ কি? অন্ধ বাড়ি ছেড়ে পথে বেরিয়ে
পড়ল।
এরপর হাঁটতে হাঁটতে নগরের শেষ প্রান্তে নদীর তীরে
উপস্থিত হল। কিন্তু এখন নদী পার হবে কি করে? মনের দুঃখে অন্ধ নদীর পাড়ে বসে পড়ল। এমন
সময় এক কুঁজোও নদীর দিকে আসছিল, অন্ধকে পাড়ে বসে থাকতে দেখে সে সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা
করল— অন্ধ ভাই, তুমি এখানে কি করছো?
তোমার চোখে জল কেন?
অন্ধ চোখের জল মুছতে মুছতে বলল— কে? কুঁজো ভাই নাকি?
কুঁজো বলল— হ্যাঁ, তুমি এখানে বসে আছো কেন? তখন অন্ধ তার মায়ের
কথা খুলে বলল, চিরদিনের জন্য সে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে তাও বলল। সব শুনে কুঁজো বলল— আমারও একই ব্যাপার ভাই, হাত থেকে
একটা গ্লাস মাটিতে পড়ে ভেঙ্গে গেছে বলে বাবা আমাকে কি মারটাই না মারল। তাই মনের দুঃখে
এই দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি।
কুঁজোর কথা শুনে অন্ধ করুণ হেসে বলল— ভালই হয়েছে। এবার থেকে আমরা দুজন
এক সাথে থাকতে পারব। তুমি আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে, আর আমি তোমাকে কাঁধে তুলে নেব।
কিন্তু এখন সমস্যা হল এই নদী পার হওয়া যায় কি করে?
কুঁজো সান্তনা দিয়ে বলল— দেখ বন্ধু পথে বেরিয়ে এত চিন্তা
করলে হয় না, চল আগে নৌকা করে ওপারে যাই, তারপর যা হয় হবে।
এই বলে কুঁজো অন্ধের হাত ধরে নৌকায় চেপে বসল। ওপারে
পৌছে দেয়ার পর মাঝি তাদের কাছ থেকে পয়সা চাইল। পয়সার কথা শুনে কুঁজো করুণ কন্ঠে বলল— দেখ বাপু আমরা এদেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি,
আমাদের কাছে একটা পয়সাও নেই। যদি কোনদিন ফিরে আসি সুদ সমেত তোমার পয়সা মিটিয়ে দেব।
মাঝি লোকটি ভাল ছিল। সে মনে মনে ভাবল একজন কুঁজো অন্যজন অন্ধ, ওরা পয়সা পাবে কোথা থেকে।
পৃষ্ঠা ১
মাঝির হাত থেকে ছাড়া পেয়ে দুজনে হাঁটতে লাগল। এক সময়
ক্লান্ত হয়ে অন্ধ বলল—
ভাই, কুঁজো এখনও কি অন্ধকার হয়নি? কুঁজো বলল— সূর্য ডুবে গেছে তবে এখনও আলো আছে।
-তবে তো এখন থামতে হয় বন্ধু। এরপর অন্ধকার হয়ে গেলে
আর পথ চলতে পারব না, আশপাশের কোন বাড়ি দেখতে পাচ্ছ?
কুঁজো চারদিকে চোখ বুলিয়ে বলল, একটা কুঁড়েঘর দেখতে
পাচ্ছি।
-অন্ধ বলল- তবে সেখানেই চল, আজকের রাতটা কাঁটানো যাক।
দুজনে উপস্থিত হল কুঁড়েঘরের সামনে। কুঁজো চিৎকার করে
ডাকতে লাগল- ভেতরে কে গো আমরা বড্ড বিপদে পড়েছি।
অন্ধ বলল- মহাশয় আমরা অনেক দূর থেকে আসছি, পথশ্রমে
ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। অনুগ্রহ করে রাতটুকু যদি আপনার বাড়িতে আমাদের আশ্রয় দেন তবে বিশেষ
উপকার হয়।
গৃহস্বামী খুব দয়ালু ছিল, একজন অন্ধ আর একজন কুঁজোকে
দেখে তার মনে দয়া হলো। সে বলল- কিন্তু
আপনারা কি আমার এই কুটিরে থাকতে পারবেন? আমি ধোপার কাজ করি আর এটাই আমার কুটির।
অন্ধ
লজ্জিত হয়ে বলল ও কথা কেন বলছেন, আমাদের সকলের একমাত্র পরিচয় আমরা মানুষ।
গৃহস্বামী
বলল- আপনাদের যদি কোন আপত্তি না থাকে তবে থাকতে পারেন।
গৃহস্বামী তাদের ভেতরে নিয়ে খাওয়া থাকার বন্দোবস্ত
করে দিল।
-খুব ভোরের অন্ধ কুঁজোকে ডেকে বলল- ভোর হতে চলল। আমাদের
আর এখানে থেকে লাভ কি? চল বেড়িয়ে পড়ি, ঘরে নেওয়ার মত কিছু আছে কি?
কুঁজো চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বলল- দুটো কাপড় আছে।
অন্ধ
বলল- তাই নিয়ে চল।
অন্ধকার
থাকতে থাকতে দুজনে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো। এক সময় বেলা পড়ে গেল, গত দিনের মত তারা আবার
আশ্রয় নিল এক চুনির বাড়ি। পরদিন ভোরবেলা চুনির বাড়ি ছাড়ার সময় অন্ধ বলল- ভাই কুঁজো
নিয়ে যাওয়ার মত কিছু আছে কি?
কুঁজো চারদিকে চোখ বুলিয়ে বলল- চুনরী বড্ড কৃপণ, ঘরে
কিছুই রাখেনি। শুধু এক ভাড় চুন পড়ে আছে। অন্ধ বলল- কোথায় কখন কি প্রয়োজন হয়? ঐ চুনই
নিয়ে চলো।
সেদিন রাতে তারা আশ্রয় নিল এক ঢুলির বাড়িতে। ভোর হওয়ার
সাথে সাথে অন্ধের ঘুম ভেঙে গেল, কুঁজোকে ঘুম থেকে তুলে অন্ধ বলল- ভাই মনে হচ্ছে ভোর
হয়ে গেছে, চলে এখনই বেরিয়ে পড়ি। ঘর ত্যাগ করার সময় কুঁজো বলল- ভাই একটা ফাটা ঢোলক পড়ে
আছে নেব?
অন্ধ বলল- নিয়ে নাও। ফাটা ঢোল নিয়ে তারা আবারও যাত্রা
শুরু করল।
সেদিন রাতে তারা আশ্রয় নিল এক নাপিতের বাড়ি। নাপিত
অতিথিদের সমাদরে আশ্রয় দিল। পরদিন ভোরবেলা কুঁজোর ঘুম ভেঙে গেল। সে অন্ধকে ডেকে বলল-
ভাই প্রতিদিন তুমি আমাকে ডেকে তোল, আজ আমার ঘুম আগে ভেঙেছে চল বেরিয়ে পড়ি। অন্ধ ঘুম
থেকে জিজ্ঞাসা করল- আচ্ছা কুঁজো ভাই, আমরা কি কি জিনিস পেয়েছি?
পৃষ্ঠা ২
কুঁজো থলে খুলে বলল- দু’খানা কাপড় এক ভাঁড় চুন, একটা
ফাটা ঢোলক, আর একটা ক্ষুর।
অন্ধ বলল- এগুলি যত্ন করে রেখো।
দুজনে হাঁটতে হাঁটতে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে তখন একটা
গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নেয়। এইভাবে এক সময় রাতের অন্ধকার নেমে আসে। অন্ধ জিজ্ঞাসা করল-
কুঁজো ভাই, আমরা এখন কোথায় এলাম?
কুঁজো বলল- কোন লোকজন তো দেখতে পাচ্ছি না তবে সামনে
একটা বিরাট বড় অট্টালিকা রয়েছে।
কুঁজো বলল- ভাই অন্ধ এত বড় অট্টালিকায় কি আমাদের আশ্রয়
মিলবে?
অন্ধ বলল- তুমি আমার হাত ধরে আগে নিয়ে চল, তারপর আমি
যা জানতে চাইবো তার উত্তর দেবে।
কুঁজো অন্ধের হাত ধরে অট্টালিকায় প্রবেশ করল। প্রথমে
দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে অনেকবার চিৎকার করে ডাকল, কিন্তু কোন সারা শব্দ পেলো না। বাধ্য
হয়ে দুজনে অট্টালিকার ভেতরে প্রবেশ করল। কুঁজোর মাথা ঘুরে গেল। অবাক হয়ে সে চারদিকে
দেখতে লাগল, কুঁজোর কাছ থেকে কোন সারাশব্দ না পেয়ে অন্ধ জিজ্ঞাসা করল- কি ব্যাপার,
কোন কথা বলছো না কেন?
কুঁজো বলল- ভাই অন্ধ এ আমরা কোথায় এলাম? ঘরের চারপাশে
মোহর আর মাণিক্য পাহাড়ের মত চাঁই করে রাখা রয়েছে।
কুঁজোর কথা শুনে অন্ধ অবাক হয়ে বলল- তুমি কি দিনের
বেলায় স্বপ্ন দেখছো না কি!
অন্ধ বলল- না গো না, স্বপ্ন নয়, এই দেখ মোহর।
কুঁজো এক মুঠো মোহর অন্ধের হাতে দিল, আনন্দে তার মুখ
উজ্জ্বল হয়ে গেল। সে বলল- ভাই কুঁজো, এতদিনে আমাদের দুঃখ দূর হয়েছে, ভগবান আমাদের দিকে
মুখ তুলে তাকিয়েছে।
এদিকে এ অট্টলিকায় একদল রাক্ষস বাস করত, সারাদিন তারা
বনে- বাদাড়ে নদীর ধারে ঘুরে বেড়াত। গভীর রাতে আস্তানায় ফিরে আসতো, সেদিন একটা রাক্ষস
একটু তাড়াতাড়িই অট্টলিকায় ফিরে এল। অট্টলিকায় প্রবেশ করে ভাজাভুজির গন্ধ পেয়ে অবাক
হয়ে রান্না ঘরের দিকে গেল। রান্নাঘরের দরজা বন্ধ দেখে জিজ্ঞাসা করল- রান্নাঘরে কে রে?
রান্না ঘরের দরজায় খিল তুলে দিয়ে কুঁজো আর অন্ধ খাবার
তৈরী করছিল, গৃহস্বামীর গলা শুনে তারা চমকে উঠল, অন্ধ ভয় কাটিয়ে ভেতর থেকেই বলল- তুই
কে?
রাক্ষস এই প্রশ্নে ভীষণ রেগে গিয়ে বলল- আমি রাক্ষস।
অন্ধ খিক্ খিক্ করে হেসে বলল- ও তুই রাক্ষস! আমি
তোর বাবা খোক্কস।
খোক্কসের নাম শুনে রাক্ষসটা একটু দমে গেল। বলল- দেখি
তোমরা কেমন খোক্কস? থুতু ফেলে দেখাও তো?
অন্ধ বলল- আগে তুই থুতু ফেলে দেখা, তারপর আমরা ফেলব।
রাক্ষস একদলা থুতু জানলা দিয়ে রান্নাঘরে ফেলল। রাক্ষসের থুতু দেখে অন্ধ চুনের ভাঁড়
থেকে একদলা চুন বাহিরে নিক্ষেপ করে বলল- এই দেখ আমাদের থুতু। ধবধবে সাদা একদলা থুতু
দেখে রাক্ষসটা ভাবল সত্যি সত্যিই হয়তো তাদের বাবা খোক্কস এসেছে। সে তখন আরো নিশ্চিত
হওয়ার জন্য বলল- দেখি তোমাদের লেজ, কেমন বড় আর শক্ত?
পৃষ্ঠা ৩
অন্ধ ঢোলক বাজাবার বেতের লিকলিকে লাঠিটা জানালা দিয়ে
বাড়িয়ে দিয়ে বলল- এই আমাদের লেজ, রাক্ষস লেজ ভেবে লাঠিটাকে কামড়াতে লাগল। এক সময় ক্লান্ত
হয়ে বেতের লাঠিটাকে ছেড়ে দিল। তখন অন্ধ বলল- এবার তোর লেজটা দেখা তো?
রাক্ষস জানালা দিয়ে তার নিজের লেজটা বাড়িয়ে দিল। অন্ধের
কথায় কুঁজো সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুর দিয়ে রাক্ষসের লেজটা কেটে দিল। ‘ওরে বাবা গো’ বলে চিৎকার
করতে করতে অট্টলিকা থেকে পালিয়ে গেল রাক্ষসটা।
রাক্ষসটা পালিয়ে গেলে অন্ধ বলল- ভাই কুঁজো এখানে থাকা
আর ঠিক হবে না। চল এক্ষুনি এখান থেকে পালিয়ে যাই, হয়তো রাক্ষসটা তাদের দলবল নিয়ে ফিরে
আসবে, তখন আর নিস্তার নেই।
কুঁজো বলল- কিন্তু ভাই, এত সব মোহর মণিমাণিক্য ফেলে
চলে যাবো?
কুঁজোর কথায় অন্ধ বলল- তা কেন, ধোপার ঐ দুটো কাপড়ের
মধ্যে যত পার মোহর আর মাণিক্য বেঁধে নাও।
ধোপার দুটো কাপড়ের মধ্যে কুঁজো বোঝাই করে মণিমাণিক্য
বেঁধে নিল। তারপর তারা অট্টলিকা ত্যাগ করে আবার যাত্রা শুরু করল। যে পথে তারা অট্টলিকায়
প্রবেশ করেছিল সে পথে গেল না, অন্য পথ ধরে তারা উর্ধ্ব শ্বাসে ছুটতে লাগল, পথে অন্ধের
জন্যই তাদের দেরি হতে লাগল।
কুঁজো অন্ধের হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অনেকটা পথ
যাওয়ার পর ওরা দাঁড়িয়ে পড়ল। শুনতে পেল, মেঘের গর্জনের মত রাক্ষসদের ভয়ঙ্কর চিৎকার।
এই পথেই তারা আসছে, কুঁজো থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে অন্ধকে বলল- ভায়া এবার কি হবে? ওরা
যে আমাদের গিলে খাবে। অন্ধ বলল- এত ঘাবড়ালে কি চলে? আমি যা জিজ্ঞাসা করছি তার উত্তর
দাও, আশপাশে কোন বড় গাছ আছে? কুঁজো বলল- একটাই মাত্র তালগাছ আছে।
অন্ধ প্রফুল্ল চিত্তে বলল- চল আমরা গাছের উপরে উঠে
বসি। এই বলে তারা দুজনে তাড়াতাড়ি গাছের ওপর উঠে বসল।
এদিকে রাক্ষসের দল তাদের খুঁজতে খুঁজতে তালগাছের নিচে
এসে হাজির হল। তালগাছের উপরে কুঁজো অন্ধের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁপতে কাঁপতে বলল- ভায়া ওরা
গাছের নিচে এসে পড়েছে, এবার কি হবে?
অন্ধ কুঁজোকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল- ভয় পাওয়ার কিছুই
নেই। রাক্ষসেরা তালগাছে চড়তে পারে না। রাক্ষসের দলে সেই লেজ কাটা রাক্ষসটিও ছিল, হঠাৎ
সে দেখতে পেল গাছের উপর দুজন জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে, সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে সে দলপতিকে
বলল- ঐ তালগাছের উপর খোক্কস দুটো বসে আছে। দলপতি তখন চিৎকার করে বলল- আয় বেটা গাছের
নিচে নেমে আয় ঐ তাল গাছের উপর থেকে, খোক্কস দেখি একবার।
অন্ধ খিক্ খিক্ করে হেসে বলল- যদি ক্ষমতা থাকে গাছের
উপর উঠে আয়।
পৃষ্ঠা ৪
রাক্ষস দল সমস্যায় পড়ে গেল, লেজকাটা রাক্ষসটা রাগে
ক্ষোভে বলল- আমি তালগাছ ধরে নিচে নেমে বসছি। তোমরা এক এক করে আমার কাঁধে চড়ে বসো, দলপতি
ভেবে দেখল প্রস্তাবটা মন্দ নয়, সঙ্গে সঙ্গে সে বললো, সেই ভাল, তোমরা একে অপরের কাঁধে
চড়ে খোক্কস দুটিকে নিচে নামিয়ে আনো।
লেজকাটা রাক্ষসের কাঁধে লাফিয়ে এক রাক্ষস উঠে গেল।
তার কাঁধে আরেক রাক্ষস, এই ভাবে ধীরে ধীরে উপরে উঠতে লাগল। এদিকে কুঁজো রাক্ষসদের কাণ্ড
দেখে ভয়ে অন্ধের গলা জড়িয়ে ধরে বলল- ভায়া এবার কি হবে? রাক্ষসেরা যে একে অপরের কাঁধে
চড়ে উপরে উঠে আসছে।
অন্ধ বিরক্ত হয়ে বলল- আঃ ফ্যাচ ফ্যাচ করছো কেন? যা
বলছি মন দিয়ে শোন, যখন দেখবে আর একটা রাক্ষস কাঁধে উঠলেই আমাদের ধরতে পারবে তখন আমার
চুল টানবে। এই বলে অন্ধ তালগাছ থেকে একটা তাল ছিঁড়ে তার মধ্যে চুন মাখাতে লাগল।
কুঁজো হঠাৎ অন্ধের চুল ধরে জোরে টান মারল। আচমকা এত
জোড়ে টান দেওয়ায় অন্ধ চিৎকার করে বলল- এত জোড়ে টান দিলি কেন? দাঁড়া তোকে মজা দেখাচ্ছি।
এই বলে সেই চুন মাখা তালটা সজোরে নিক্ষেপ করল মাটিতে।
নিচের লেজকাটা রাক্ষসটা ভাবল- খোক্কস হয়তো ভীষণ রেগে
গেছে। সাদা তালটা দেখে সে আরো বেশি ভয় পেয়ে গেল। সে ভাবল, হয়তোবা খোক্কসের দল রাগ হয়ে
সবার উপরের রাক্ষসটার মাথা টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে। সঙ্গে সঙ্গে পড়ি কি মরি করে কাঁধ সরিয়ে
দে ছুট। বাকিরা আর যায় কোথায়? তালগাছের মত হুড়মুড় করে রাক্ষসের দল মাটিতে আচড়ে পড়ল।
এই দেখে দলপতি ত্রাহি ত্রাহি রবে চিৎকার করে বলতে লাগল, যদি প্রাণ বাঁচাতে হয় তবে খোক্কসদের
হাতের বাইরে চলে যাও, এই বলে দলপতি পেছন ঘুরে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল।
রাক্ষসদল পালিয়ে গেলে অন্ধ আর কুঁজো গাছ থেকে নেমে
পড়ল। এরপর চলতে চলতে এক সময় তারা পৌঁছে গেল সেই নদীর ধারে। কুঁজো নদীর তীরে বাঁধা অবস্থায়
একটা নৌকা দেখে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বলল, ভায়া মাঝি নৌকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ভালই হল।
কুঁজো আর অন্ধ নৌকার সামনে গিয়ে হাতে দুটি মোহর দিয়ে
বলল- আমাদের চিনতে পারছ?
মাঝি একগাল হেসে বলল- চিনতে পারবা না কেন! আর তোমরা
এত টাকা দিচ্ছ কেন? আমি তো তোমাদের কাছ থেকে মাত্র দু’পয়সা পাব।
অন্ধ বলল- এই সামান্য ক’টা টাকা তোমাকে উপহার দিলাম।
সেদিন বিপদে তুমিই একমাত্র আমাদের সাহায্য করেছিলে। এখন তুমি আমাদেরকে এমন এক নতুন
জায়গায় পৌঁছে দাও, যেখানে প্রাণের অস্তিত্ব নেই, শুধু আমি আর আমার বন্ধু কুঁজো থাকব
সেখানে। মাঝি তাদের ইচ্ছেমত তাদেরকে এক জনমানবহীন মরুভূমিতে নামিয়ে বিদায় নিল।
পৃষ্ঠা ৫
মরুভূমিতে এসে অন্ধ কুঁজোকে বলল- একটা জায়গায় বসে
মোহর আর মণিমুক্তোগুলো ভাগাভাগি করে নেই।
অন্ধ চোখে দেখতে পায় না। তাই কুঁজো মোহর আর মণিমুক্তোগুলো
দুটো ভাগে ভাগ করতে লাগল। একটা ভাগে বেশি বেশি করে সব রেখে অন্ধকে বলল- ভাই অন্ধ সমান
ভাগে দুটো ভাগ করেছি, এবার তোমার যে ভাগ ইচ্ছে নিয়ে নাও।
অন্ধ দুটো ভাগে হাত দিয়ে বেশি ভাগটা দেখিয়ে বলল- এটা
নেব।
অবস্থা বেগতিক দেখে কুঁজো বলল- বন্ধু ভাগাভাগি ঠিক
হয়নি, আর একবার ভাগাভাগি করতে হবে।
এই ভাবে বার বার কুঁজো দু’ভাগে ভাগ করতে লাগল— এক ভাগে বেশি আর অন্য ভাগে কম,
প্রতিবারই অন্ধ বেশি ভাগটা দেখিয়ে দেয়। একসময় অন্ধের উপর কুঁজো বিরক্ত হয়ে ওঠে। সে
বলে- ‘কোন কিছুই তোকে দেব না, যা কিছু পেয়েছিল সব আমার দৌলতে, কারন আমি দেখতে পাই আর
আমিই এগুলো সংগ্রহ করেছি।’
অন্ধ দু’হাতে চোখ ঢেকে নিল, দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে
পড়ছে, একটু পরে চোখ থেকে হাত সরিয়ে নিল। এ কি আশ্চর্য ব্যাপার! সব দেখতে পাচ্ছে সে,
অন্ধর চোখ পুরোপুরি ভাল হয়ে গেছে, সঙ্গে সঙ্গে সে চিৎকার করে লাফিয়ে উঠে কুঁজোর পিঠে
এক লাথি মেরে বলল— হতভাগা এই আমি সাথে ছিলাম বলে আমার বুদ্ধির জোরে
তুই এখনো বেঁচে রয়েছিস, এর বিপদ কেটে যাওয়ার পর এখন কিনা আমার সাথেই.....
কুঁজোর পিঠে লাথি মারার সাথে সাথেই পিঠের কুঁজ অদৃশ্য
হয়ে সাধারণ মানুষের মত হয়ে গেল। সে তখন চিৎকার করে বলল— ভায়া তুমি দেখতে পাচ্ছ? আর এই
দেখ আমারও পিঠে আর কুঁজ নেই।
অন্ধ দেখল, সত্যি সত্যি পিঠের কুঁজ কোথায় যেন মিলিয়ে
গেল। কুঁজো অন্ধের হাত ধরে বলল— ভাই ভালই হল, ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্যই। বিবাদ
না হলে তুমি না তোমার চোখ ফিরে পেতে, আর না আমার কুঁজ ঠিক হত।
***** সমাপ্ত *****