গোন ও কোমার বন্ধুত্ব (জাপানের লোককহিনী) || লোককাহিনী ৩

 

সারমর্ম: গোন ও কোমা নামক দুটো জাপানি বিড়ালের বন্ধুত্বের গল্প। মোট-৩ পৃষ্ঠা


জাপান আমাদের এশিয়া মহাদেশের একটি দেশ। বরং বলা চলে, জাপানকে নিয়েই এশিয়া গর্ব করতে পারে ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে। সেই জাপানের লোকগল্পের আমাদের দেশে কিন্তু খুব একটা পরিচিতি নেই। এবার আমরা শুনবো সেই জাপানরই একটি লোকগল্পের কাহিনী।

জাপানের এক প্রদেশে গোন নামে এক হুলো বিড়াল ছিল। বিড়ালটি দেখতে ছিল খুবই সুন্দর। সে তার চোখ দিয়ে অন্ধকারেও সবকিছু দিনের আলোর মতই পরিষ্কার দেখতে পেতো। সে থাকতো এক সংগীতশিল্পীর বাসায়। গোনকে সেই শিল্পী প্রচুর পছন্দ করতেন। কোনকিছুর বিনিময়েই গোনকে হাতছাড়া করতে রাজি ছিলেন না সেই শিল্পী।

ঐ শিল্পীর বাড়ির কাছেই বাস করতেন এক সুন্দরী রমণী। তার সারক্ষণের সঙ্গী ছিল কোমা নামের ছোট্ট একটি পোষা বেড়াল। খুবই মার্জিত, রুচিশীল ও অভিজাত প্রকৃতির বেড়াল ছিল কোমা। অত্যন্ত ভদ্রভাবে সে মাস, কাঁটা, দুধ ইত্যাদি খাবারগুলো খেতো। খাবার পর সে তার ছোট গোলাপী জিব দিয়ে মুখ, হাত, পা চেটে চেটে পরিষ্কার করতো। এতে তার কোন ভুল হতো না। তার মালিক সবসময় বলতো, ‘কোমা, কোমা, তুই না থাকলে আমার কী হবে রে’?

একদিন গোন ও কোমা এই দুই বেড়ালই তাদের নিজ নিজ বাড়ি থেকে ভ্রমণে বের হয়েছিল। ঘুরতে ঘুরতে একটা চেরি বৃক্ষের নিচে তাদের দুজনের দেখা হয়ে গেল। গাছটি তখন ফুলে ফুলে ছেয়ে গিয়েছিল। প্রথম দর্শনেই বেড়াল দুটির একে অপরকে ভালো লেগে যায়।

গোন বেশ কিছুদিন ধরেই ভাবছিল যে এবার তার একটি সাথি দরকার, কিন্তু আশপাশে যেসব পুষিক্যাটের সঙ্গে তার দেখা হতো তাদের কেউই ওর মনঃপূত হয়নি। তবে কোমাকে দেখামাত্রই তার মনে হলো, এরকম একটি বিড়াল বন্ধুর কথাই সে যেন এতদিন মনে মনে ভেবে এসেছে। ওদিকে কোমারও মনে হলো গোনই তার বন্ধু হবার যোগ্যতা রাখে। কিন্তু উভয়ই তাদের পথে বেশ কিছু বাধা দেখতে পেল।

প্রথমত, গোন তার প্রভু সংগীতশিল্পীর কাছে গিয়ে অনুরোধ জানালো তিনি যেন কোমাকে ঐ ভদ্রমহিলার কাছ থেকে কিনে তার বাড়িতে নিয়ে আসে। কিন্তু সংগীতশিল্পী গোনের প্রস্তাবে রাজি হলেন না। এদিকে কোমাও তার মালিককে অনুরোধ করল যে, তিনি যেন গোনকে কিনে তার বাড়িতে নিয়ে আসেন। কিন্তু কোমার মালিকও তার কথায় কোন কর্ণপাত করলেন না। ফলে গোন-কোমার ইচ্ছা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে চলল। অবশেষে গোন ও কোমা বাসা থেকে পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়।

একদিন চাঁদনি রাতে তারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। সারারাত, পরের সারাদিন তারা পথে পথে ঘুরে বেড়াল। তারপর তারা এসে পৌছল একটা ভারি সুন্দর পার্কে। সেখানে চমৎকার গাছ-গাছালি, ঠান্ডা আবহাওয়া, স্নিগ্ধ ছায়াঘেরা পরিবেশ বিরাজ করছিল। গোন-কোমার কাছে মনে হলো এ যেন স্বর্গোদ্যান।


পৃষ্ঠা ১



কিন্তু কাছেই লুকিয়ে অপেক্ষা করছিল বিরাট আকারের একটা রাক্ষস। তার চার পা, বিশাল লেজ, ধারালো দাঁত আর থাবা নিয়ে সে সুযোগ খুঁজছিল ওদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। রাক্ষসটি সামনে আসা মাত্রই কোমা ঝটপট তার কাছের চেরি গাছটায় উঠে বসলো, আর গোন তার দাঁতমুখ খিচিয়ে গলার মধ্যে গড়গড় আওয়াজ তুলে বন্ধুকে বাঁচাবার জন্যে রুখে দাঁড়ালো।

কিন্তু রাক্ষসটা ছিল যেমন বৃহদাকার তেমনি ভয়ঙ্কর। তার বিরুদ্ধে গোনের টিকে থাকার কোনো আশাই ছিল না। ভাগ্যক্রমে একটি ভৃত্য এদের গড়গড় শব্দ ও তর্জন-গর্জন শুনে পার্কে এসে উপস্থিত হয়। সেখানকার কান্ড-কারখানা দেখে সে রাক্ষসটাকে তাড়িয়ে নিয়ে তার খাঁচায় ঢুকিয়ে দেয়। তারপর গোনকে কোলে তুলে নিয়ে ঐ পার্কের মালিক রাজকুমারীর কাছে নিয়ে গেল। কোমা চেরি গাছের উপরে উঠে বসায় তাকে ভৃত্য দেখতে পেল না।

গোন যখন রাজকুমারীর কাছে এসে পৌছল তখনও কোমা সেই চেরি গাছের মাথায় বসেই রইলো।

রাজকুমারী গোনকে খুব আদর-যত্ন করলেন। কিন্তু কোমাকে ছাড়া তার কিছুই ভালো লাগে না। কোন উপায় না দেখে গোন মনে মনে ভাবলো, একটু ধৈর্য ধরে থাকি, দেখা যাক কি করা যায়।

গোন একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়েই যেন রাজকুমারীর কাছে এসেছিল।

কিছুকাল ধরে এক দুষ্টু জাদুকর রাজকুমারীর প্রেমে পড়ে গিয়ে তাকে করায়ত্ত করার জন্য নানারকম জাদুর আশ্রয় নিচ্ছিল। সে প্রায়ই বিভিন্ন রূপ নিয়ে রাজকুমারীর কাছে এসে তাকে জ্বালাতন করতো। একদিন রাজকুমারী বারান্দায় বসে আপন মনে গুনগুন করে গান গাইছিলেন, এমন সময় হঠাৎ তার মনে হলো যে জানালা বেয়ে কি যেন উপর দিকে উঠে আসছে।

এক নজর দেখেই তিনি বুঝতে পারলেন ঐ দুষ্টু জাদুকর নতুন ছদ্মবেশে তার কাছে আসতে চলছে। সে দেখতে পেলো একটি ভয়ংকর সাপ জানাল বেয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকলো। সাপটিকে এঁকেবেঁকে অগ্রসর হতে দেখেই রাজকুমারী ভয়ে চিৎকার করে মূর্ছা গেলেন। গোন বসে বসে এই অবস্থা দেখছিল। সাপটি রাজকুমারীর কাছে পৌছামাত্রই গোন সঙ্গে সঙ্গে সাপটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তার ধারালো দাঁতের কামড়ে সাপটিকে মেরে ফেলল। এরফলে, যে জাদুকর এতদিন রাজকুমারীর জীবনকে অভিশপ্ত করে তুলেছিল তার জীবন মুহূর্তে শেষ হয়ে গেল।

গোন তো আগে থেকেই রাজকুমারীর প্রিয় ছিল, আর এখন এই ঘটনার পর থেকে তার প্রতি রাজকুমারীর ভালোবাসা আরো দশগুণ বেড়ে গেল। কিন্তু যতই যাই হোক না কেন, কোমাকে গোন কিছুতেই ভুলতে পারে না, তাই তার সুখও কখনো পরিপূর্ণ হয় না।

একদিন সে রাজকুমারীর জানালার চৌকাঠে বসে রোদ পোহাতে পোহাতে পার্কের দিকে তাকাতেই দেখল বড়োসড়ো কদাকার একটা হুলো বেড়াল একটা ছোটখাটো পুষি-ক্যাটকে খুব জ্বালাতন করছে, তাকে ভয় দেখাচ্ছে।


পৃষ্ঠা ২



গোনের চিরকালের স্বভাব সবল অত্যাচারীর বিরুদ্ধে দুর্বলের পক্ষ নিয়ে লড়াই করা। ফলে, এই ঘটনায় গোন লাফ দিয়ে পার্কে ছুটে গেল, তারপর আঁচড়ে-কামড়ে-খামচে হুলোটাকে পার্কের বাহিরে তাড়িয়ে দিল।

সে যখন পুষিক্যাটটাকে সান্তনা দেবার জন্য ঘুরে তার দিকে তাকালো তখন বিস্ময়য়ের সঙ্গে সে লক্ষ করল যে ঐ পুষি বেড়ালটি তো আর কেউ নয়, তারই হারিয়ে যাওয়া বন্ধু কোমা।

গোন মিউ মিউ করে কোমাকে ডাক দিতেই কোমা তার কাছে ছুটে যায়। তারা বারবার একে অন্যের নাকে নাক ঘঁষে দেয়, আর গড়গড় শব্দ করতে থাকে। তারা দুজনে বন্ধু হয়ে একসাথে বাস করার ইচ্ছা প্রকাশ করল।

গোন কোমাকে রাজকুমারীর কাছে নিয়ে গেল। রাজকুমারী খুশি হয়ে বললেন, ঠিক আছে! তোমরা দুজন আজ থেকে রাজপ্রাসাদেই থাকবে।

            

***** সমাপ্ত *****

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post