সাত ভাই চম্পা (বাংলাদেশী রূপকথার গল্প) || রূপকথার গল্প ১

 

সারমর্ম: এক রাজার বড় রানীরা ছোট রানীর উপর হিংসে করে তার সন্তানদের কি অবস্থা করেছিল এবং এর পরিণামে যা ঘটেছিল। মোট-৩ পৃষ্ঠা

এক ছিল রাজা। তার ছিল সাত রানি। বড় ছয় রানির খুব অহংকার ছিল, ছোট রানি ছিলেন খুব শান্ত। এজন্য রাজা ছোট রানিকে সকলের চেয়ে বেশি পছন্দ করতেন।

কিন্তু রাজার কোন ছেলে মেয়ে ছিল না। এত বড় রাজ্য, কে ভোগ করবে? রাজার মনে তাই দুঃখ ছিল।

এভাবে দিন কেটে যেতে থাকে। অনেকদিন পর ছোট রানি সন্তানসম্ভবা হল। রাজার মনে তাই বিশাল আনন্দ, পাইক-পিয়াদা ডেকে রাজা রাজ্যে ঘোষণা করে দিলেন- 'রাজা রাজ ভান্ডার খুলে দিয়েছেন, মিঠাই-মন্ডা, মণি-মানিক, যে যত পারো, এসে নিয়ে যাও।'

ছোট রানি সন্তানসম্ভবা হওয়ায় বড় ছয়রানি হিংসায় জ্বলে মরতে লাগলো।

রাজা নিজের কোমরের সাথে ছোট রানির কোমরে এক সোনার শিকল বেঁধে দিয়ে বললেন, 'যখন ছেলে হবে, এ শিকলে নাড়া দিও, আমি এসে ছেলে দেখব!’ এই বলে, রাজা রাজ দরবারে চলে গেলেন। 

ছোট রানির ছেলে হবে, আঁতুড় ঘরে কে যাবে? বড়রানি বললেন, 'আহা, ছোটরানির ছেলে হবে, তা অন্য লোক দেবো কেন? আমরাই যাব।'

বড়রানিরা আঁতুড় ঘরে গিয়ে শিকলের নাড়া দিলেন। অমনি রাজসভা ভেঙ্গে ঢাক-ঢোলের বাদ্য বাজিয়ে মণি- মানিক সাথে করে রাজা এসে দেখেন কিছুই না!

রাজা ফিরে গেলেন।

রাজসভায় বসতে না বসতেই আবার শিকলে নাড়া পড়ল। রাজা আবারও ছুটে গেলেন। গিয়ে দেখেন, এবারও কিছুই না। মনের কষ্টে রাজা রাগ করে বললেন - 'ছেলে না হতে আবার শিকল নাড়া দিলে আমি সব রানিকে কেটে ফেলব।' বলে রাজা চলে গেলেন।

একে একে ছোটরানির সাতটি ছেলে একটি মেয়ে হলো। আহা, ছেলেমেয়েগুলো যেন চাঁদের পুতুল, ফুলের কলি। আকুপাকু করে হাত নাড়ে, পা নাড়ে আঁতুড়ঘর আলো হয়ে গেল।

ছোটরানি আস্তে আস্তে বললেন, 'বুবু কী ছেলে হলো একবার দেখালে না!

বড়রানিরা ছোটরানির মুখের কাছে অঙ্গভঙ্গি করে হাত নেড়ে, নথ নেড়ে বলে উঠলেন, ছেলে না, হাতি হয়েছে, ওর আবার ছেলে হবে! কটা ইঁদুর আর কটা কাঁকড়া হয়েছে।'

শুনে ছোটরানি আজ্ঞান হয়ে পড়ে রইলেন।

নিষ্ঠুর বড় রানিরা চুপিচুপি হাঁড়ি-সরা এনে ছেলেমেয়েগুলোকে তাতে পুরে পাশের গাঁদায় পুঁতে রাখলেন। তারপর শিকল ধরে টান দিলেন।

রাজা আবার ঢাক-ঢোলের বাদ্য বাজিয়ে, মণি-মানিক সাথে নিয়ে ছুটে এলেন। বড় রানিরা হাত মুছে, মুখ মুছে তাড়াতাড়ি করে কতগুলো ব্যাঙের ছানা, ইঁদুরের ছানা এনে দেখালেন।

এসব দেখার পরে রাজা প্রচন্ড রেগে গেলেন আর ছোট রনিকে রাজপুরী থেকে বের করে দিলেন। বড় রানিদের মুখে আর হাসি ধরে না, পায়ের মলের বাজনা থামেনা। ছোট রানীকে বের করে দেওয়ার ফলে বড় রানিদের সুখের কাঁটা দূর হলো। বড় রানিরা মনের সুখে ঘরকন্না করতে লাগলেন।


পৃষ্ঠা ১



এদিকে ছোট রানি ঘুঁটে-কুড়ানি দাসী হয়ে, পথে পথে ঘুরতে লাগলেন।

এমন করে দিন কাটতে থাকে। রাজার মনে সুখ নেই, পুরো রাজ্যে সুখ নেই, রাজপুরী খাঁ খাঁ করে, রাজার বাগানে ফল ফোটে না।

একদিন মালি এসে বলল - 'মহারাজ, ঘর সাজানোর জন্য ফুল পাই না, তবে আজ পাঁশগাদার উপরে চাঁপা ও পারুল গাছে, টুলটুলে সাতটি চাঁপা ও একটি পারুল ফুল ফুটে আছে।’

রাজা বললেন- 'তবে সেই ফুলগুলো তুলে আনো ওগুলো দিয়েই ঘর সাজাবো।'

মালি ফুল আনতে গেল।

মালিকে দেখে পারুল গাছের পারুল ফুল চাঁপা ফুলগুলোকে ডেকে বললো- 'সাত ভাই চম্পা জাগো রে!'

অমনি সাত চাঁপা নড়ে উঠে সাড়া দিল ‘কেন বোন পারুল ডাকোরে।

পারুল বলল, ‘রাজার মালি এসেছে, ফুল দিবে কি না দিবে?’

সাত চাঁপা তুরতুর করে উপরে উঠে গিয়ে ঘাড় নেড়ে বলতে লাগল-

না দিব, না দিব ফুল, উঠব শতেক দূর, আগে আসুক রাজা, তবে দিব ফুল!’

এই ঘটনা দেখার পর মালি তো পুরোই অবাক হয়ে গেল। ফুলের সাজি ফেলে দৌড়ে গিয়ে মালি রাজার কাছে খবর দিল।

ঘটনা শোনার পর আশ্চর্য হয়ে রাজা এবং রাজসভার সকলে সেখানে আসলেন।

রাজা এসে ফুল তুলতে গেলেন, আর অমনি পারুল ফুল চাঁপা ফুলদের ডেকে বলল-

সাত ভাই চম্পা জাগরে!

চাঁপারা উত্তর দিল, ‘কেন বোন পারুল ডাকোরে?’

পারুল বলল, ‘রাজা এসেছেন, ফুল দেবে কি না দেবে?’

চাঁপারা বলল- ‘না দিব, না দিব ফুল, উঠব শতেক দূর, আগে আসুক রাজার বড় ছয় রানি, তবে দিব ফুল’। এই বলে চাঁপা ফুলেরা আরো উঁচুতে উঠে গেল।

রাজা বড় রানিদের ডেকে আনলেন। প্রথমে বড় রানি মল বাজাতে বাজাতে এসে ফুল তুলতে গেল।

চাঁপা ফুলেরা তখন বলল ‘না দিব, না দিব ফুল, উঠব শতেক দূর, আগে আসুক রাজার মেজরানি, তবে দিব ফুল।

তারপর মেজরানি গেলেন, সেজরানি গেলেন, ন’রানি গেলেন, কনে রানি গেলেন- কিন্তু কেউ-ই ফুল তুলতে পারলেন না। ফুলেরা এতটাই উপরে উঠল যে তারা গিয়ে আকাশে তারার মত ফুটে রইল।

রাজা গালে হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়লেন।

শেষে দুয়োরানি গেলেন, তখন ফুলেরা বলল না দিব, না দিব ফুল, উঠব শতক দূর, যদি আসে রাজার ঘুঁটে-কুড়ানি দাসী তবে দিব ফুল।

তখন ঘুঁটে-কুড়ানি দাসীকে খুঁজতে অনেক লোক বেরিয়ে পড়ল। রাজা চৌদোলা পাঠিয়ে দিলেন, পাইক পেয়াদারা চৌদোলা নিয়ে মাঠে গিয়ে তাকে খুঁজতে লাগল। একসময় তারা ঘুঁটে-কুড়ানি দাসী অর্থাৎ রাজ্য থেকে বের করে দেয়া রাজার সেই ছোটরানিকে নিয়ে আসলো।


পৃষ্ঠা ২



ছোট রানির হাতে পায়ে গোবর, পরনে ছেঁড়া কাপড়, তাই নিয়ে তিনি ফুল তুলতে গেলেন। আর সবাইকে আশ্চর্য করে দিয়ে অমনি সুড়সুড় করে চাঁপারা আকাশ থেকে নেমে এলো, পারুল ফুলটিও গিয়ে তাদের সঙ্গে মিশলো। চাঁপা ফুলগুলোর মধ্যে হতে সুন্দর সুন্দর চাঁদের মতো সাত রাজপুত্র আর পারুল ফুলটি থেকে এক রাজকন্যা ‘মা মা’ বলে ডেকে, ঝুপঝুপ করে ঘুঁটে-কুড়ানি দাসী ছোটরানির কোলের উপরে ঝঁপিয়ে পড়ল।

এমন দৃশ্য দেখে তো সকলে অবাক। রাজার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়ল। বড়রানিরা তো ভয়ে কাঁপতে লাগল।

রাজা তৎক্ষণাত নির্দেশ দিলেন যে বড় ছয় রানিকে কেটে ঐ স্থানে পুতে রাখতে। রাজার আদেশ পালন করা হল। বড় ছয় রানিকে হত্যা করে পুঁতে রাখা হল।

এরপর সাত রাজপুত্র, এক রাজকন্যা আর ছোটরানিকে নিয়ে রাজা রাজপুরীতে চলে গেলেন।

রাজপুরীতে আনন্দের বাজনা বেজে উঠল। রাজ্যে আবারো সুখ ফিলে আসলো। গাছে গাছে ফুল ফুটল, পাখিরা ডালে ডালে বসে গান গাইতে থাকলো। রাজা, রাজপুত্র, রাজকন্যা, রানি, মন্ত্রী, রাজদরবারের সদস্যবৃন্দ এবং প্রজারা মনের সুখে রাজ্যে বসবাস করতে লাগল।


***** সমাপ্ত *****

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post